শিমুল দিনাজপুর প্রতিনিধি :
আদরের সন্তান মোখলেছার রহমান মাদকসেবন করে এসে প্রতিনিয়ত মারধর করতো নিজ গর্ভধারিণী মাকে। হায়রে কলি কাল, নিজ সন্তানের হাতে মারধর হলো বর্তমানের কাল। এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুর সদর উপজেলার ৩নং ফাজিলপুর ইউনিয়নের রানীপুর গ্রামের মৃত খাজামদ্দিন শাহ এর সহধর্মিনী জাহেদা বেওয়ার উপর। ৮০ বছর বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে সে। এই বয়সেও ছেলের হাতে বার বার মার খেতে হচ্ছে। হত্যার হুমকি শুনতে হচ্ছে তাকে। মাদকাসক্ত ছেলের নির্যাতন সইতে না পেরে মা বাদী হয়ে ছেলের নামে কোতয়ালী থানায় অভিযোগ প্রদান করলেও এখন পর্যন্ত মামলা রুজু হয়নি। তবে মাদকাসক্ত ছেলে নিজের কুকর্ম, কুকীর্তি আড়াল করতে মামলায় ফাঁসালেন বৃদ্ধা মাসহ নিজ পরিবারকে।
অভিযোগে জাহেদা বেওয়া উল্লেখ করেন যে, মো. মোখলেছুর রহমান (৫২) আমার ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট। সে একজন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী। আমি মা হিসেবে সন্তানকে মাদকের হাত থেকে রক্ষার জন্য একাধিকবার দুরে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার অভিযোগে মো. আবেদ আলী ওরফে মানিক, মো. সোহেল, মো. মুজাহিদ, ফরিদা বেওয়া নামধারী মাদকসেবনকারীদের জন্য আমার ছেলেকে মাদকমুক্ত করতে পারিনি। মাদকসেবন করে আমার ছেলে বাড়িতে এসে আমাকে ও তার দুই ছেলে অর্থ্যাৎ আমার দুই নাতি মো. নাহিদ হাসান ও জাহিদ হাসানসহ ছেলের বউ লাইলি বেগমকে বিভিন্ন সময় মারপিট করে জখম করে। আমার কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে তার দুই ছেলে ও স্ত্রীর কাছে টাকা চায়। টাকা না দিলে আমাদেরকে মারধর করে বাড়ি হতে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। বাড়ি বিক্রি করে মাদকসেবন ও মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করবে।
অভিযোগে তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমার ছেলেকে ভালো করার জন্য ২০১৭ সালে তিনমাস ও ২০১৯ সালে ৬ মাস এবং ২০২০ সালে চারমাস করে পর্যায়ক্রমে মাদকাসক্ত শোধণাগার অশ্রু ও ভাবনায় চিকিৎসার জন্য রেখেছি। কিন্তু আমার ছেলে কিছুদিন পর উক্ত শোধণাগার হতে বের হয়ে এসে পুর্বের ন্যায় আচরণ করে এবং মাদকসেবীদের সাথে মেলামেশা করে পুনরায় মাদক গ্রহণ করে। গত ১২ মে ২০২০ তারিখে আমার ছেলে মোখলেছুর রহমান মাদকসেবন করার জন্য আমার নিকট টাকা চায়। আমি টাকা দিতে অস্বীকার করলে আমার ছেলে আমাকে ও তার স্ত্রীসহ দুই ছেলেকে এলোপাথারী মারপিট করে। একপর্যায়ে তার ছোট ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে বাশের শক্ত লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করতে গেলে আমার ছোট নাতি বাম হাত দিয়ে রক্ষা করতে যায়। এতে লাঠির আঘাতে তার হাতটি ভেঙ্গে যায়। প্রতিনিয়ত নির্যাতনের পরও আমার ছেলে মোখলেছার রহমান যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি মা হয়ে গত ১০ জুন ২০২০ তারিখে তার চিকিৎসার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ঠিক তখন আমার ছেলের মাদকসেবী (অভিযোগে উল্লিখিত) বন্ধুরা হঠাৎ করে লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বড় নাতি নাহিদ হাসানকে মারধর শুরু করে। আমিও আমার বউমা লাইলি বেগম ও ছোট নাতি হাফেজ জাহিদ হাসান তাকে বাঁচানোর জন্য দৌড়িয়ে গেলে তারা আমাদেরকেও মারধর করে। এর একপর্যায়ে আমার বউমার পড়নের কাপড় টানে হিচঁড়ে খুলে ফেলে শ্লীলতাহানী ঘটিয়ে আমার ছেলে মোখলেছার কে তাদের সাথে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে তোদেরকে রাতের আঁধারে মেরে ফেলবো বলে হুমকি প্রদান করে।
নিরূপায় হয়ে নিরাপত্তা হীনতায় ভুগে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিরাপত্তার আশ্রয় চেয়ে দিনাজপুর কোতয়ালী থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করি। আমি অসহায় দেখে আমার অভিযোগটি মামলা আকারে দায়ের হয়নি।
সরেজমিনে রানীপুর গ্রামের রাজাপাড়ায় গেলে জাহেদা বেওয়া প্রতিবেদককে অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, বা’ মোর ছোট ছইল নেশা খাইয় আসিয়া বাড়ির খোলানত মোক দেখা পাইয়া অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। মুই চুপচাপ থাকো বা’। মুই পর্দার সহিত থাকার জন্য ছেলোয়ার কামিজ পড়িয়া মাথায় ঢাকা দিয়া থাকো। মুই বুড়া মানুষ শাড়ি পড়িলে কাপড় ঠিক থাকেনা বা’। মোর ছইল মোক কহে এই বুড়ি তুই কি এখন চেংড়ি হইছি, জুয়ান ফিরি পাইছি। এইগুলি গালি দিতে দিতে বা’ মোর গোরত আসিয়া এমন মারিবার শুরু করিছে। মারি ফেলার জন্য মোর টুটি চিপে ধরিলে মোর কাপড়ত প্রসাব-পায়খানা করিয়া দ্যাও। মোর নাতি দেখা পাইয়া চিল্লাইতে চিল্লাইতে দৌড়াই আসিলে মোক ছাড়ি দিয়া তখন মোর নাতিকে মারধর করে। পরে মোর চিল্লানিতে আশেপাশের মানুষ দৌড়াই আসিলে তখন নেশাখোর ছইল পালাই যায়। তখন মোর পরি থাকা নাতি খাড়া করিলে দেখো বা’ বাম হাতটা ভাঙ্গি গেইছে। হামরা নাতিক দিনাজপুর সদর হাসপাতালে নিয়া আসিয়া চিকিৎসা করাই।
মোখলেছার রহমানের মেঝো ভাই মাহবুবুর রহমান, স্ত্রী লাইলী বেগম, বড় ছেলে নাহিদ হাসান, ছোট ছেলে জাহিদ হাসান বলেন, আমার ভাই, আমার স্বামী, আমার বাবা তাঁর প্রাপ্ত সকল সম্পত্তি বিক্রি করলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। এখন শেষ সম্বল শুধু মাথা গোজানোর ঠাঁই হিসেবে বাড়িটুকু আর রানীপুর বাজারে তিনটি দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। শেষ সম্বলটুকুও যদি সে বিক্রি করে তাও আমাদের কোন আপত্তি নেই, যেহেতু তার নামীয় সম্পত্তি। তবে আমি তার স্ত্রী ও আমরা তার সন্তান হয়ে এইটুকুই দাবী করতে পারি যে, আমাদের মাথা গোজার ঠাঁইটুকু থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।
এদিকে, আমার বাবার নামে দিনাজপুর কোতয়ালী থানায় মাদকদ্রব্যের মামলা রয়েছে। এই মামলায় জেলও খেটেছে। তবুও আমরা আমাদের পিতার পাশেই ছিলাম, আছি, থাকবো।
অত্র ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার বাবলুর রশিদ বাবু বলেন, মোখলেছার রহমান মাদকসেবন করে বাড়িতে থাকা তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও ছেলেদের প্রায়ই মারধর করে। যার কারণে মোখলেছারের প্রতি গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ফাজিলপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মোখলেছার রহমান রাণীগঞ্জ ও রাণীপুর বাজারে তাকে সকলেই এক নামেই চেনে ডাব্বু মোখলেছার। সে মাদকসেবন, জুয়া ও অশ্লীল কার্যকলাপে জড়িত। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানতে পারি যে, সে প্রতিনিয়ত মাদকসেবন করে। তার বাড়িতে বৃদ্ধা মাসহ স্ত্রী সন্তানদের মারধর করেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আমার কাছে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেন নি।
কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, জাহেদা বেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি আমি জানি। এখনও তদন্ত চলছে। তবে সুষ্টু তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে জাহেদা বেওয়ার ছোট ছেলে মোখলেছার রহমানের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, মোখলেছার রহমান উল্টো মারপিটের অভিযোগ এনে নিজে বাদী হয়ে দিনাজপুর কোতয়ালী থানায় ৮০ বছরের বৃদ্ধা মা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে ১১ জুন ২০২০ তারিখে একটি মামলা দায়ের করে।