করোনা কালের জীবন ধারা – ৩৪

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর বেপরোয়া আক্রমণে সারা বিশ্বের মানুষ আজ দিশেহারা। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে বিশ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। মৃত্যুর সংখ্যা দেড় হাজারের উপরে। ঠিক এমনি একটি সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য মানুষ কিছুতেই সহজভাবে মেনে নিতে পারছেনা। তিনি কেন এবং কিসের ভিত্তিতে এমন কথা শোনালেন? নাকি তার মুখ ফসকে এমন হতাশার কথা বেরিয়ে পড়েছে? মুখ ফসকে বের হলে সে বাক্য সংক্ষিপ্ত হয়। তাঁর বাক্য তো সংক্ষিপ্ত আকারের নয়!
আমি একটি ঘটনার কথা জানি। তখন আমি জামালপুরের সরিষাবাড়িতে উপজেলা ভূমি অফিসে উপজেলা কানুনগো হিসেবে কর্মরত। সেখানে এসি ল্যান্ডের পদ শুন্য থাকায় মূল দায়িত্বে ইউএনও সাহেব থাকলেও প্রায় সকল কাজ দেখাশোনা আমাকেই করতে হতো। কারণ রাজস্ব প্রশাসনের সর্ব নিম্ন পদ সহকারি তহশিলদার থেকে পদোন্নতি পেয়ে তহশিলদার এবং পদবী পরিবর্তনের পর ভূমি সহকারি কর্মকর্তার পদ থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো হওয়া। ইউএন সাহেব তাই জেলা পর্যায়ের ভূমি সংক্রান্ত কাজে আমাকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্ব দিতেন। আমার জন্য আরেকটি বাড়তি সুবিধা ছিলো, পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবুল হাসেম সাহেব পদোন্নতি পেয়ে তখন জামালপুরের জেলা প্রশাসক। পাবনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে তিনি আমাদের পাশে থেকেছেন। তাই জামালপুরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে তিনি আমাকে দাওয়াত করার কথা ভুলতেননা। একবার জামালপুর সদর হাসপাতালের একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আগমণে ব্যাপক আয়োজন। জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন জামালপুরের সিভিল সার্জন। সভাপতির ভাষণের শেষাংশে তিনি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলতে গিয়ে বলে ফেল্লেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ। বলার পর পরই তিনি তা শুধরে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি সমান সমান। একবার বের হয়ে গেলে তা আর ফেরানো যায়না। তাঁর এহেন কথায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। পরদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যানার হেডে খবর ছাপা হলো। তার পর যা হবার তাই……..।
২০০২ সালের ৯ মে রামপুরায় বাবার কোলে থাকা ২০ মাসের শিশু নওশিন হত্যার পর শোকার্ত পরিবারের প্রতি চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন বলেছিলেন, ‘‘ আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে!’’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এ ধরণের বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনা শুরু হয়েছে। কারণ এটা সকলের বাচাঁ-মরার কথা। জীবনাবশান ও জীবনধারণের কথা। কোন অবস্থাতেই এটি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
এমনিতেই গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগি সনাক্ত হওয়ার পর থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিলোনা। সমন্বয়ের ঘাটতিও প্রবল। স্বাস্থ অধিদপ্তরের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে গত সপ্তাহে কমিশন গঠনের কথা আলোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদে। করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার অদক্ষতা নিয়ে যখন সারা দেশে কথা হচ্ছে, তখনি মহাপরিচালক বিশেষজ্ঞদের দোহাই দিয়ে বল্লেন , করোনা সহজে যাওয়ার নয়।”
আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি তিন মাস ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নানা পরামর্শ দিচ্ছে। এই কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, দু তিন বছর করোনা থাকবে – এমন কোন কথা তারা সরকার বা অধিদপ্তরকে বলেন্ ি। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি নামে ১৭ সদস্যের আরেকটি কমিটি আছে, যারা সরকারকে করোনা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে। এই কমিটির ও একাধিক সদস্য বলেছেন, তারা এরকম কথা কখনো বলেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কাছে তাঁর বক্তব্যের ভিত্তি কি তা জানতে চেয়েছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সারা বিশে^ জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এই ভাইরাস সহজে যাচ্ছেনা। উচ্চহারে সংক্রমণ হয়তো হবেনা। সংক্রমণ দু-তিন বছর থাকবে। দেশবাসিকে আগেভাগে এ বিষয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার।
এবিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন মন্তব্য বুঝতে পারছিনা। আপনি যদি সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেন, তাহলে করোনা আজীবন থাকব্ েএরকম কথার অর্থ হচ্ছে হাল ছেড়ে দেওয়া। ’
তাইতো পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা হরিপুরের চৌধুরী বংশের প্রখ্যাত লেখক প্রমথনাথ চৌধুরী লিখেছিলেন,‘‘ বাঘে যদি ধান খায়, আর ডাক্তার যদি ঘন ঘন ভগবানের নাম করে তাহলে বুঝতে হবে সর্বনাশের আর বাঁকি নেই।’’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালকের মন্তব্য যদি এমন হতাশাব্যঞ্জক হয় তাহলে সর্বনাশের আর বাকি রইলো কোথায়?
অবশ্য গত ১৯ জুন, স্বাস্থ্য াধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুক্রবার এক প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক(ডিজি) বক্তব্যের স্ক্রিপটি তৈরি করতে করতে স্বাস্থ্য বুলেটিনের সময় হয়ে যাওয়ায় তিনি সেটি ভালো করে পরীক্ষা করার সুযোগ পাননি। স্ক্রিপটি পাঠ করে অনলাইনে বক্তব্য দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, ঐ বক্তব্যটিতে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রেসবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রেরিত নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবির স্বাক্ষরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তি বলছে, গতকাল (বৃহস্পতিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের একটি বক্তব্যকে ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছ্ েএ বিষয়ে মহাপরিচালক গভীরভাবে দুঃখিত।’’
করোনাভাইরাসের বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের জামিয়াত –উলেমা- এ ইসলাম এর সভাপতি ফজল-উর রহমান এক নতুন কথা শুনিয়েছেন দেশবাসিকে। তিনি বলেছেন,‘‘ কোভিড-১৯ এর সঙ্গে লড়াই করার জন্য সকলের ঘুমানো উচিত। কারণ, আমরা যত বেশি ঘুমাই , ভাই্রাসও তত বেশি ঘুমায়। করোনা আমাদের ক্ষতি করবেনা। তিনি বলেন, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি , ভাইরাসও ঘুমিয়ে পড়ে, আমরা যখন মরে যাই এটিও তখন মারা যায়।’’ যা শুনে হেসে লুটোপুটি নেট দুনিয়ার মানুষ। (দি-ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-১৭জুন,২০২০)। )। (চলবে)

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।