জমে উঠছে চলনবিল এলাকার খলসুনি ও ধুন্দির হাট

বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় জমে উঠেছে চলনবিল এলাকার খলসুনি মতান্তরে চাই ও ধুন্দির নামকরা হাট গুলো। চাটমোহরের “অমৃতাকুন্ডা হাট” ঘুড়ে দেখা যায়, করোনা’র প্রভাবে হাটে লোক সমাগম কম হলেও কেনা-বেচা বেশ ভালই চলছে। প্রতি রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ হাটে খলসুনি ও ধুন্দি কেনা বেচা হয়। এ ছাড়া, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ হাট,গুল্টা হাট, রায়গঞ্জের নিমগাছীর হাট, সলঙ্গা হাট, চাটমোহরের ছাইকোলা হাট, মির্জাপুর হাট, নাটোরের গুরুদাশপুর হাট, চাচকৈড় হাটসহ চলনবিল এলাকার অন্যান্য হাটে ও খলশুনী পাইকারি ও খুচরা ক্রয়-বিক্রয় হয়। পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পাইকাররা এসব হাটে এসে খলসুনী কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। তবে খলসুনি ও ধুন্দি পরিবহনের সময় গ্রামীন ও আঞ্চলিক সড়ক মহাসড়কে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা দিতে হয় বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক।


বর্ষায় ক্ষেতে কাজ না থাকায় চলনবিল অঞ্চলের অভাবী হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য মাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত হন। তাই বর্ষায় খলসুনি বা ধুন্দির কদর ও বেড়ে যায়। মাছ ধরার এ উপকরণগুলো তৈরীর কাজ সারা বছর চললেও প্রতিবছর এ সময় খলসুনী ও ধুন্দি তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। জৈষ্ঠের শেষ থেকে এর পূর্ণ মৌসুম শুরু হয়ে যায়। বাঁশ, তালের আঁশ আর লই দিয়ে তৈরী মাছ ধরার যন্ত্র খলসুনী ও ধুন্দি তৈরী করে এখন স্বাচ্ছন্দে জীবন কাটাচ্ছেন চলনবিল এলাকার চাটমোহর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, তাড়াশ, সিংড়াসহ এর আশপাশ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। আর এ যন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ধরে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন হাজার হাজার জেলে।


চলনবিল এলাকায় প্রথম কে কবে কোথায় খলসুনি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। স্থানীয় প্রবীণ ব্যাক্তিরা জানান, তাদের দাদার আমল থেকেই তারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। অনেকে নতুন করে আসছে এ পেশায়। অনেকে জানান, বংশানুক্রমে তারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত।
চলনবিল অধ্যুষিত বড়াইগ্রামের রানীর হাটের শহিদুল ইসলাম (৪৭) জানান, প্রথমে বাঁশ চিরে খিল তোলা হয়। সেগুলো শুকিয়ে নেয়া হয় হালকা রোদে। পঁচানো তালের ডাগুরের আঁশ দিয়ে বাঁশের খিল বান দেয়া হয়। এসব কাজে গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরাও পরিবারকে সহায়তা করে থাকে। চলনবিলাঞ্চলের ধারাবারিষা, উদবাড়িয়া, সিথুলী, তালবাড়িয়া, সিরামপুর, দারিকুশি, চন্ডিপুর, সোনাবাজুসহ বিভিন্ন গ্রামে এখন দিন-রাত চলছে খলসুনী তৈরির কাজ। তিনি আরো জানান, গত ১৫ বছর যাবত এ পেশায় সম্পৃক্ত আছেন। প্রতি জোড়া খলসুনী চার থেকে পাঁচ’শ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি। বাড়ির বৌঝিরাও কাজে সহায়তা করে বলে কোন রকমে খেয়ে পরে দিন চলে যায় বলে জানান তিনি।
দাড়িকুশী গ্রামের আব্দুল মতিন জানান, “ আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলে বাড়ির এ তিনজন ধুন্দি তৈরী করি। সপ্তাহে দশ-বারোটি ধুন্দি তৈরী করতে পারি। উপকরণ হিসেবে তরলা বাঁশ, তালের আশ, নাইলনের সুতা প্রয়োজন হয়। সাড়ে চার’শ থেকে পাঁচশ টাকা জোড়া ধুন্দি বিক্রি করি। নিজে তৈরীর পাশাপাশি শীতের সময় যখন দাম কম থাকে তখন খলসুনী ও ধুন্দি কিনে রাখি। এসময়ে বিক্রি করি। পাবনার বিভিন্ন এলাকাসহ সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ঢাকার ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে এতে আমাদের সংসার চলে যায়”।
চাটমোহরের ধরইল মৎসজীবি পাড়ার রফিক জানান, খলসুনী তৈরী তার পৈত্রিক পেশা। স্ত্রী ও দুই সন্তানের সহায়তায় সপ্তাহে তিনি ছয়-সাতটি ধুন্দি তৈরী করতে পারেন। তার পাড়ার ৪শ পরিবারের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩শ পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত। তিনি আরো জানান, নিজের জমাজমি নাই। খলসুনি, ধুন্দি তৈরী করে দিনাতিপাত করছি। অন্যের বাড়িতে কাজে যেতে হচ্ছে না। আকার ভেদে খলশুনীর দামে রয়েছে অনেক তারতম্য। ৪শ থেকে ২ হাজার টাকা জোড়া পর্যন্ত বিক্রি হয় খলসুনী। প্রতি জোড়ায় তাদের ১শ টাকার মতো লাভ থাকে।
বাঁশ নির্ভর এ শিল্পে সম্পৃক্ত হয়ে উৎপাদনকারী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা, ব্যবহারকারীরাসহ সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত হচ্ছেন। ছোট মাছের চাহিদার একটা বিরাট অংশ মেটাচ্ছে এ শিল্প। তবে ক্রেতারা অভিযোগ করেন চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাটসহ অধিকাংশ হাটে প্রতিটি খলসুনীর জন্য ২০ টাকা খাজনা আদায় করেন ইজারাদার যা অত্যন্ত অযৌক্তিক। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মমাফিক খাজনা আদায় করার দাবী জানিয়েছেন ক্রেতারা। এ ছাড়া খলসুনী বা ধুন্দি কিনে পরিবহনের সময় সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা দিয়ে গন্তব্যে পৌছিতে হয় চালককে। পরিবহন চালক ও ব্যবসায়ীরা চাঁদা আদায় বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।