করোনা কালের জীবন ধারা-৩১

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি নানা দেশি- বিদেশী সংস্থা কাজ করে চলেছে। জাতিসংঘ, বিশ^ স্বাস্থ্য
সংস্থাসহ (ডাব্লিউএইচও) বৈশি^ক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিতই। এর মধ্যে সর্বশেষ জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র ‘ বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি : প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া
পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশে^ উদ্ভুত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং করণীয় বিষয়ক ওই প্রতিবেদনের কথা। জাতি সংঘের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, নাগরিক সমাজের বেশ কিছু অংশিদার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ওই পরিকল্পনা নথি তৈরি করা হয়।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশি^ক নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ওই পরিকল্পনা নথি তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ^ ব্যাপি করেনাভাইরাস মহামারির পেক্ষাপটে সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘের সংস্থা ও অংশিদারদের
কার্যকরভাবে প্রস্তুত করা হয়।
জাতি সংঘ তথ্য কেন্দ্র জানায়, সারা বিশে^র মতই বাংলাদেশে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য জলদি কোন
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়বে। জনগণের প্রতি প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থা মেনে চলার জন্য আহবান জানানো হয়। উক্ত নথির শুরুতেই করোনাভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী
প্রভাব ও ভয়বহতা অনুধাবন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে এটি একটি এমনি প্রাণঘাতি রোগ যা আমাদের সাড়া দেওয়ার গতির চেয়ে বেশি গতিতে সংক্রমিত হয়। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিশ^ব্যাপি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ। সঙ্গে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ংকর করোনাভাইরাসও। ৭ শ ৭০ কোটি
জনগোষ্ঠির এই বিশে^ করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণের হার উচ্চ ও আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমেই সংক্রমিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মাত্রার জনঘনত্ব বিবেচনা করে বৈশি^কভাবে স্বীকৃত পন্থা অবলম্বন করে ধারণা করা যায়, এখনই প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেওয়া না হলে মহামারির প্রভাবে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মৃত্যু
ঘটতে পারে। প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি বিষয়ক বিশ^ব্যাপি স্বীকৃত মডেলের হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা না হলে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ
মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, করোনা প্রতিরোধে সামান্য দেরিও বিশে^র দেশে দেশে করোনাভাইরাসে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ
করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে রোগিদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা দুর্বল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে
মহামারি রোধ করা কঠিন হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হলে অন্যান্য রোগিদের চিকিসাও বাধাগ্রস্ত হবে। রোগির ঘনত্বের তুলনায় দক্ষ
স্বাস্থ্যসেবাকর্মির অভাব বাংলাদেশে প্রবল। এছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত অনুশীলন ও দক্ষতার অভাব, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের
(পিপিই) অপ্রাচুর্যতা, রোগির বহুল ঘনত্ব মিলিয়ে করোনা মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন বলে সতর্ক করা হয়।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রচলিত সামাজিক আচার ও মেলামেশার কারণে করোনা মহামারিতে রূপ নওেয়ার সম্ভাবনা এখানে প্রবল। তবে বাংলাদেশ সরকার এরই মাঝে অতি দ্রুততার সাথে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন। তবে ভাইরাসটির ঝুঁকির ব্যপারে ব্যাপকভাবে অবহিত করা, সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে করোনা পরীক্ষায় যে ব্যবস্থা রয়েছে তা একেবারেই অপতুল।
জাতীয়ভাবে রোগ নির্ণয় ও নির্ভুলতার জন্য পরীক্ষায় নিযুক্তদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বিবিসির বরাত দিয়ে পদ্মাটাইমস ডেক্স গত এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে বিশেষ সংবাদে উল্লেখ করেছিলো,তাতে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেছিলেন, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা যত বাড়ানো হবে আক্রান্তের সংখ্যাও তত বেশি পরিবর্তন হবে। আমাদের
পরীক্ষার সংখ্যা খুবই সীমিত। আমরা যদি একদিনে ১ হাজার নমুনা পরীক্ষা না করে ১০ হাজার নমুমনা পরীক্ষা করতে পারতাম তাহলে আক্রান্তের
সংখ্যা পুরো পাল্টে যেতো। রিদওয়ানুর মনে করেন, যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে তাতে বোঝা যাবেনা যে দেশে কত রোগি আছে। বরং এটা দিয়ে বোঝা যাবে যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চলমান রয়েছে। দেশে কত রোগি আছে তার হিসাব বের করতে হলে ১০ থেকে ২০ হাজার পরীক্ষা করতে হবে বলে তিনি জানান।
সেসময় সরকারের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফেøারা বলেছিলন,ভাইরাসটির বৈশিষ্ট পরিবর্তন হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট করে কোন
কিছু বলা সম্ভব নয়। আমাদের এখন রাইজিং ট্রেন্ড অর্থাৎ সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। আমাদের ঝুঁকি দিন দিন আরো বাড়ছে। পিক এ কবে পৌঁছাবে সেটা আমি এখন বলবোনা। তার মতে এখন কোন ধরণের
ধারণার কথা বল্লেও আসলে শেষমেষ তা কাজে নাও আসতে পারে। যদিও আমরা একটা মডেলিং করে প্রেডিকশন করেছি, কিন্তু সেটা নিয়ে
এখনই আমরা কোন মন্তব্য করতে চাইনা, কারণ এখনো সেসময় আসেনি।
রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে বিশে^র অন্য দেশের মতই করোনাভাইরাসের মত মহামারি সামাল দিতে যেহেতু আমাদের দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থা যথেষ্ট
নয়, তাই সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে মারাত্মকভাবে সংক্রমণের শিকার মানুষের সংখ্যা সীমিত রাখা যায়।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগি সনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এমাসে মোট রোগি সনাক্ত হয়েছিলো ২ শ ১৮ জন। পরের মাসে
সনাক্ত হয় ১৩ হাজার রোগি। ৩ মাসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৬৮ হাজার জনে। এরপর এই ৯ দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ আজ ১০২ তম দিনে
আক্রান্তের সংখ্যা ৯৮ হাজার ৪ শ ৮৯ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজার ৩ শ ৫ জন এবং সুস্থ্য হয়েছেন ৩৮ হাজার ১ শ ৮৯ জন। এখন অবস্থাদৃষ্টে দেখা
যাচ্ছে আক্রান্ত যেমন বাড়ছে, মৃত্যুর হারও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। করোনাভাইরাসের শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারেনা। তবে আশার কথা এই যে, মৃত্যুর পাশাপাশি
সুস্থ্যতার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১