নাটোর কারাগারের প্রধান ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ বাক্যটি এখানে শুধুই শ্লোগান। আসলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেলে তার উল্টো চিত্র। এই কারাগারে যার যত বেশি প্রভাব, সে তত বেশি প্রভাবশালী। আর যাদের প্রভাব নেই তাদের হতে হয় সাজাপ্রাপ্তদের নির্যাতনের শিকার। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনা সহসা প্রকাশ করেন না কেউ। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন প্রকার অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার যেতে হয় কারাগারে। তবুও সদ্যকরামুক্ত অন্ততঃপক্ষে ২০ জন ব্যক্তি জানান, নাটোর কারাগারের বর্তমান চালচিত্র ।যা দেখে মনে হয়েছে ,আলোর পথ দেখানোর নামে তারা বন্দী ও হাজতীদের অন্ধকার পথেই নিয়ে যাচ্ছে ।
নাটোর জেলা কারাগারে টাকা আছে যার কারাগার বাসা তাঁর। কারাবন্দিদের নি¤¬মানের খাবার, ক্যান্টিনে গলাকাটা দাম । নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে বাসা থেকে আসা থেকে আসা খাবার-দাবার এবং পরিধেয় পোষাক কিছুই নিতে দেয়না কারা কর্তৃপক্ষ। বাজার দরের চেয়ে দ্বিগুন তিনগুন দামে খাবার এবং জামা কাপড় কিনতে হয় কারাগারের ক্যান্টিন থেকে।
জেলা কারাগারে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অনেকগুলো খাতের মধ্যে একটি হলো… কারা ক্যান্টিন। টাকা জমা দিয়ে ক্যান্টিন থেকে পছন্দমতো খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করেন কারাগারের ভেতরের বন্দিরা। কিন্তু নাটোর জেলা কারা ক্যান্টিনে যে দামে জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়, আর কোথাও এতো দামে জিনিসপত্র বিক্রি হয় না। দাম শুনলে সাধারণ মানুষ অবাক হবেন। পাঁচ থেকে দশগুণ বেশি দামে কারা ক্যান্টিনে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হয়। এছাড়া ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশে বন্দিদের খুবই নিæমানের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে অর্থ হাতিয়ে নেয় ।কারা কর্তৃপক্ষসহ বন্দিদের কাছ থেকে টাকা আদায়কারী সিন্ডিকেট। কারাগার থেকে ফেরত আসা লোকজন জানিয়েছেন, ২৫ টাকা কেজির পেঁয়াজ ১০০ টাকায়, ২০ টাকার আলু টাকা, ৩৫ টাকা হালির ডিম ১৪০ টাকা, ১৫০ টাকার তেলাপিয়া মাছ ৬০০ টাকা, ১৮০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগির মাংস ৬০০ টাকা, ৩০০ টাকার দেশি মুরগি ৭০০ টাকা, ৪৫০ টাকার গরুর মাংস ১১০০ টাকা, ডারবি সিগারেট ৬৫ টাকার প্যাকেট ১১০ টাকা, ১২০ টাকার সিগারেট ২০০ টাকা, আকিজ বিড়ি ১৭ টাকার স্থলে ৪০ টাকা, ৫৫ টাকার চিনি ১১০ টাকা ও ৪০ টাকা কেজির আতপ চাল ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া এক প্যাকেট গোল্ডলিফ বাইরে ২০০ টাকার স্থলে ৩৫০ টাকা,এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট (ছোট) ১৩০ টাকা আর ক্যান্টিনে নেয়া হয় ২৩০ টাকা ।
নতুন করে নিয়ম করেছে পরিধেয় জামাকাপড় বাহির থেকে নেয়া যাবে না । ক্যান্টিন থেকেই কিনতে হচ্ছে জামা কাপড় ।১৫০ টাকার লুঙ্গী ৪০০ থেকে ৫০০টাকা । ১৫০ টাকার টাউজার ৪০০ টাকা । ৮০/৯০ টাকার গামছা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা । ২৫০/৩০০ টাকার বিছানার চাদর ৬০০ টাকা ।
রান্না করা প্রতি কেজি গরুর মাংস ১১০০টাকা,কক মুরগী প্রতি কেজি ৭০০টাকা,বয়লার মুরগী ৪৫০ টাকা,ডিম প্রতি পিস ৩০ টাকা,ভাত ১ কেজি ৩৫০ টাকা, ১০ টাকার শপিং ব্যাগ ৯০ টাকা । এভাবেই প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম দুই গুন,তিন গুন, অনেক ক্ষেত্রে চারগুন নেওয়া হচ্ছে। টাকা হলে এমন কিছু নেই যে নাটোর কারাগারে পাওয়া যায়না।যার টাকা আছে তার জন্য নাটোর কারাগার হচ্ছে সুখের জায়গা আর যার টাকা নেই তার জন্য দোযখ।
জেল সুপার আব্দুল বারেক যোগদানের পর থেকেই মূলত নাটোর কারাগারের হাজতী এবং কয়েদীদের জিম্মি করে রমরমা বাণিজ্য শুরু করেছেন। হাজতি কয়েদিরা প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে অমানুষিক নির্যাতন। ইতিমধ্যে কারাগারে আব্দুল বারেকের অনিয়ম দুর্ণীতির কথা শহরে ওপেন সিক্রেট
কিন্তু লাভের টাকা কোথায় যায়,সাধারণ কারারক্ষীরা জানেনা ।
নামপ্রকাশে অনইচ্ছুক একজন কারারক্ষী জানান,মূলত আব্দুল বারেক নটোর কারাগারে সুপার হিসেবে যোগদানের পর থেকে রমরমা ক্যান্টিন বাণিজ্য শুরু হয় ।।জেলের সব কিছু নিয়ে বাণিজ্যের কারণে তাকে সবাই “ফিটিং বারেক” নামেই চেনে এবং জানে।
প্রতিদিনই শতশত লোকের কাছ থেকে অতিরিক্ত হারে টাকা আদায় করে সেই টাকা ভাগ ভাটোয়ারা করা হয়। অভিযোগকারীদের দাবি, করাবন্দিদের প্রতিদিন সকালে আধাসেদ্ধ আটার রুটি ১টি ও কম দামের সামান্য গুড়, দুপুরে সামান্য ভাত ও আধা সেদ্ধ ডাল, রাতে ভাতের সঙ্গে নিæমানের আধাসেদ্ধ সবজী, ১০-২০ গ্রাম ওজনের এক টুকরো পাঙ্গাস মাছ দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী মাছের জাত পরিবর্তন করার কথা থাকলেও প্রতিদিনই শুধুমাত্র পাঙ্গাস মাছ বন্দিদের খাবারে দেয়া হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী
গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ বিশেষ দিবসে সকল কারাবন্দিদের জন্য উন্নতমানের খাদ্য দেয়ার কথা থাকলেও নাটোর জেলা কারাগারে তা হয় নামমাত্র। বাজারের পচা সবজি বন্দিদের জন্য মসলা ছাড়াই আধাসেদ্ধ করে দেয়া হয়। কারাগার ফেরত শহরের কান্দিভিটুয়া গ্রামের সুমন বলেন, কারাগারের ভেতরে বন্দিদের যেসব খাবার দেয়া হয় তা খাওয়ার মতো নয়। যাদের টাকা আছে তারা ক্যান্টিন থেকে
কিনেই খায়। তবে যে চড়া দামে জিনিসপত্র বিক্রি করা হয় তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না।
২০-২৫ টাকার জিনিস ২০০-২৫০ টাকা বিক্রি করে তারা। ১৫০ টাকার তেলাপিয়া মাছ ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।
নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের পন্ডিত গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী পারভেজ আহমদ ১১ দিন কারাগারে ছিলেন। তিনি বলেন, নাটোর জেলা কারাগারের ভেতরের অবস্থা খুব খারাপ। ভয়ে কেউ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে চায় না। খাবারের মান খুব বাজে।
সদর উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. নুরুল বলেন ৬ মাস ছিলেন নাটোর জেলা কারাগারে। কারাগারের ভেতরে বন্দিদের খাবারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একদিনও জেলের দেয়া কিছু খেতে পারিনি। আমার স্ত্রী ধারকর্জ করে টাকা দেওয়ার পর আমি ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খেয়েছি ।
নাটোর শহরের বড়গাছার বাসিন্দা রানা প্রামাণিক বলেন,মানুষ কারাগারে গিয়ে ভাল হবে কি করে । কারাগারের ভেতরে খাবারের ক্যান্টিন আছে কিন্তু এতে আলুর কেজি ১০০ টাকা। গরুর মাংস ১১০০ টাকা কেজি। কারাগারে প্রতিমাসে একটু ভালভাবে চলতে খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ।বাড়ির লোকজন ধার করজা করে জেলে টাকা পাঠায় । বাহির হয়ে এই টাকা শোধ করতে
গিয়ে আবার অপরাধমূলক কাজে জড়াতে হয় ।
বেশিরভাগ মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দী জানান, এসবের প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্মম নির্যাতন । নির্যাতনের
ভয়ে কেউ মুখ খুলেননা ।জেল সুপার আর জেলাররা প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা ভাগ করে নেন।।কারো কিছু বলার নেই ।
নাটোর জেলা কারাগারের নামপ্রকাশে অনইচ্ছুক একজন পরিদর্শক বলেন, জেলা কারাগারের ভেতরে অনিয়ম নিয়ে নানা অভিযোগ শুনা যাচ্ছে। যতদ্রুত সম্ভব একটি শক্তিশালী তদন্ত টিম গঠন করে এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন।
তবে জেল সুপার আব্দুল বারেক জানান, যারা জেল থেকে বের হওয়ার পর ক্যান্টিনের অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের অভিযোগ করছেন এসব অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। আমার নাটোর কারাগারের মতো নিয়ম কানুন আশে পাশের কোন কারাগারে নেই ।
এ বিষয়ে নাটোরের জেলা প্রশাসক মোহাাম্মদ শাহরিয়াজ জানান, জেলা কারাগারের নিæমানের খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনায় আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।