হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী রামায়ণ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, রামের স্ত্রী দেবী সীতাকে পঞ্চবটি বন থেকে রাবণ অপহরণ করে রথে চড়িয়ে লঙ্কায় (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) নিয়ে কোন এক অজানা স্থানে লুকিয়ে
রাখেন। এই ঘটনায় রাম ক্ষুব্ধ হয়ে যেভাবেই হোক স্ত্রীকে উদ্ধার করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি সাহায্যের আশায় সব দিকে খবর পাঠালেন। তার সেই বিপদের সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন
বানরের রাজা সুগ্রীব ও হনুমান। লঙ্কায় যাবার জন্য কোন রাস্তা না থাকায় বানর রাজা সুগ্রীবের পরামর্শে ও তার সাহায্যে সমুদ্রে পাথর ফেলে রাস্তা তৈরি করা হয়। সেই রাস্তা পাড়ি দিয়ে রামের বিশাল বাহিনী
লঙ্কায় উপনীত হয়। সীতাকে উদ্ধারে রাম ও রাবনের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে এক বুদ্ধি বের করা হয়। হনুমানের লেজে কাঁথা বেঁধে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। জলন্ত কাঁথাসহ হনুমানকে লঙ্কা শহরে ছেড়ে দেওয়া হয়। লেজে আগুন নিয়ে ভয়ে- আতঙ্কে
হনুমান এক লাফে এক বাড়ির ছাদে বসে তো আরেক লাফে আরেক বাড়ির ছাদে বসে। এমনিভাবে লাফাতে থাকে। এভাবে যতবার বসে ততবার ফুঁ
দিয়ে লেজের আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। দেখা গেলো হনুমান এভাবে লাফাতে লাফাতে প্রতিটি বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে ফেলেছে এবং সেই
আগুনে পুরো লঙ্কা শহর জ¦ালিয়ে ছাই করে দেয় যা পৃথিবীর ইতিহাসে লঙ্কাকান্ড হিসেবে পরিচিত।
বর্তমান অধুনা বিশে^ চীনদেশ থেকে কেন এবং কিভাবে যে আগুনের সুত্রপাত ঘটলো যা গোটা বিশ^কেই হনুমানের লেজের আগুনে লঙ্কা শহর
পোড়ানোর মত লঙ্কা কান্ড ঘটিয়ে সব জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। হনুমানের লেজের আগুন ছিলো দৃশ্যমান, আর এ আগুন হলো
অদৃশ্যমান। ছাইচাপা আগুনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। যাকে বলা হয় তুষের অনল।
বলছিলাম ভয়াবহ ঘাতক ব্যাধি করোনার কথা। অদৃশ্য-অষ্পৃশ্য এই করোনার আগুন চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি মার্কেট থেকে
সংক্রামিত হয়ে আজ সমগ্র বিশে^র লাখ লাখ মানুষকে চিরদিনের জন্য মাটির গহীন অন্ধকার কবরে-গণকবরে অথবা চিতায় চিরভষ্ম করে
ছাড়ছে। পিতা-মাতা আদরের সন্তানকে, সন্তানেরা পিতা-মাতাকে, স¦ামী-স্ত্রীকে, স্ত্রী তার অবলম্বনের ধন স্বামীকে,- হারাচ্ছে। নিকটতম-
দুরতম, আপন আত্মীয়- অনাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত- অপরিচিতজন এক কথায় শুধু হারানো আর হারোনো। এতে প্রাপ্তির কোন যোগ নেই।
পক্ষান্তরে কেউ তার লাগাম টেনে ধরতে পারছেনা। ‘কথায় আছে ‘‘ নগর
পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’’
অথাৎ সারা বিশে^র ২১৫ টি দেশে আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে। এপযর্ন্ত মৃত্যবরণ করেছে ৪ লাখ ২ হাজার ৫৬১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯ লাখ ৯৮
হাজার ১৯১ জন। এ থেকে আমাদের বাংলাদেশও বাদ যায়নি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৮৮৮ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫
হাজার ৭ শ ৬৯ জন।
সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিদিন যখন নীরিহ- নিরুপায় প্রাণগুলো করোনায় আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করে মৃত্যুবরণ করছে
তখন পৃথিবীর ছোটবড় শক্তিশালী কিংবা পরাক্রমশালী দেশের বাঘা-বাঘা
জ্ঞাণী-গুণী বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ কিছুতেই এর টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে সক্ষম হচ্ছেনা। এযেন সেই ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হৈমন্তী শুকলার সাড়া জাগানো গান–‘ আমার বলার কিছু ছিলোনা/
না না গো আমার বলার কিছু ছিলোনা। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম/ তুমি চলে গেলে /তুমি চলে গেলে/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম/আমার বলার
কিছু ছিলোনা। সব কিছু নিয়ে গেলে যা এনেছিলে/আনন্দ হাসি
গান সব তুমি নিলে/ যাবার বেলায় শুধু অজান্তে স্মৃতিটাই গেলে
তুমি ফেলে…. ।… কোথা থেকে কখন যে কি হয়ে গেলো /সাজানো
ফুলের বনে ঝড় বয়ে গেলো। .. সে ঝড় থামার পরে পৃথিবী আাঁধার
হলো…।’ এমন আহাজারি করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। এ এক
দারুন-নিদারুন অভিশাপ যেন। এ শাপমোচন কবে হবে কে জানে?
গত বছর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন থেকে বিশ^বাসীকে অতর্কিতে
আক্রমণ করা করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষকদের সন্দেহের শীর্ষে বিলুপ্তপ্রায় প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই। বিজ্ঞানীরা এখনো
নিশ্চয় করে বলেননি, তবে গবেষণা যে দিকে এগুচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বন
রুইএর। তাই যদি হয় তাহলে সেটা হবে প্রকৃতির চরম প্রতিশোধ।
প্যাঙ্গোলিন হলো কুমিরের মত দেখতে, নিতান্ত ছোট-খাটো বিড়ালের মাপের এক প্রাণি। কিছু প্রজাতি অবশ্য বড়-সড়ও হয়। শক্ত শক্ত আঁশে
ঢাঁকা শরীর, বিপদে পড়লে যার সাহায্যে আত্মরক্ষা করে সে। একসঙ্গে গোটা তিনেক পর্যন্ত সন্তানের জন্ম দিতে পারে।
এদের বসবাস চীন, ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণপুর্ব এশিয়া, ও আফ্রিকার কিছু বিশেষ অঞ্চল। চীন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণপুর্ব এশিয়ায় এর মাংস
হলো ডেলিকেসি। স্ট্যাটাস সিম্বল। প্যাঙ্গোলিন হটপট, প্যাঙ্গোলিন স্টার ফ্রাই ইত্যাদি সব পদ যারা খেতে পারেন তারা চিহ্নিত হন উচ্চবর্গের
মানুষ হিসেবে। মাননীয় অতিথি এলে অভ্যর্থনা হয় এসব খাবার দিয়েই। সেজন্যই এর কদর ও মূল্য দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ১ পাউন্ড
মাংসের দাম ৩০০ ডলার। প্যাঙ্গোলিনের আশেঁর বাজারও চড়া। প্যাঙ্গেলিনের আঁশ শুকিয়ে গুড়ো করে বানানো হয় ঐতিহ্যবাহি চীনা হারবাল ওষুধ।
এই ওষুধ ক্রয়ের জন্য চীনারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্যাঙ্গেলিনের কাঁটা, আঁশ ছড়িয়ে গুঁড়া করা, ওষুধ বানানো, তার
মাংস খাওয়া ইত্যাদির অবসরেই সম্ভবত ভাইরাস ঢুকেছে চীনাদের শরীরে। সেখান থেকে ছড়িয়েছে পৃথিবী জুড়ে। হংকং বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষক টমি ল্যাম জানিয়েছেন, চীনে পাচার
হওয়া মালয়ান প্যাঙ্গোলিয়নের মধ্যে এমন দুটি করোনাভাইরাস পাওয়া
গেছে যার সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক মিল রয়েছে। চীনের ওয়াংজু প্রদেশের ‘সাউথ চায়না এগ্রিকালচার ইউনিভাসির্টির
গবেষকরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন নেচার পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়েছে চীনের ওহান থেকে ছড়িয়ে পড়া যে করোনাভাইরাস
বিশ^জুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে, হুমকির মুখে মানবজাতির অস্তিÍত্ব। সেটির আর এন এ বিন্যাসের সঙ্গে প্যাঙ্গোলিনের শরীরে পাওয়া
করোনাভাইরাসের বিন্যাসের ৯৯ শতাংশ মিল পওয়া গেছে। যেভাবেই হোক না কেন করোনাভাইরাসের আঁতুড় ঘর যে চীন, তাতে কোন
সন্দেহ নেই। ইসরায়েলের এক সামরিক গবেষক ড্যানি সোহাম দাবি করেছেন, চীনের এক গবেষণাগার থেকে বিশ^জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারি
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১