জোয়ারের পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা এবং করোনা রোগীর দাফনের অজুহাতে মসজিদে নামাজ আদায়সহ গোরস্থানে কবর জিয়ারতে বাধা প্রদান এসব একই সুত্রে গাঁথা। সরকারের ভাবমূর্তি খর্ব করার এসব অপকৌশলমাত্র। এ সকল ষড়যন্ত্র তো আজকের নয়। শুরু হয়েছে স্বাধীনতার সুচনালগ্ন হতে। বর্তমানে করোনা যুদ্ধকালে, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তীকালের অনেক কথাই আজ স্মরণে আসে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা হতে দেশের মাটিতে ফিরে এসে বাঙালির স্বপ্ন পুরণে ব্রতি হলেন।
প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করলেও ভারতীয় মিত্র বাহিনী তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকায় আগমণের আমন্ত্রণ জানালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভারতীয় মিত্র বাহিনী একে একে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এ সময় অসংখ্য বাঙালি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মুজিব সরকার তাদের পুনর্বাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার, আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ স্বরূপ অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এ সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়। এতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূল নীতির কথা স্বীকৃত হয়।
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করার মানসে এবং শ্রমিকদেরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহে সরাসরি সম্পৃক্ত করার লক্ষে মুজিব সরকার দেশের ভারি শিল্প-কারখানা সমূহকে জাতীয়করণ করে।
দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সরকারি করণ ও শিক্ষকগণকে সরকারি কর্মচারি হিসাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা লাভের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য শ্রেনিভুক্ত হতে সক্ষম হয়।
যে ৯৩ হাজার যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাসদস্য যাদেরকে ভারতের কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল তাদের বাংলার মাটিতে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও প্রায় ২ বছর পর তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে পাকিস্তানে আটক কয়েক লাখ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি বহুদিন পর স্বাধীন বাংলায় নিজ মাতৃভুমিতে ফিরে আসার সুযোগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও পিসকমিটির লোকেরা যারা খুন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছিল সেই সকল ব্যক্তি বাদে ছোট-খাটো অপরাধ সংঘটনকারিদেরকে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাঁর এই মহানুভবতার সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও তাদের অনুসারীরা শেখ মুজিবকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষে মুজিব সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জাতীয় রক্ষী বাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে। এই আধা সামরিক বাহিনী সৃষ্টি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ভাল চোখে দেখেনা। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দলীয় নেতা-কর্মীগণও এ থেকে বাদ যায়না। তাদের অনেকেই দুর্নীতির চরম সিমায় উপনীত হয়।
এসময় চারদিকে নানামুখি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুভিক্ষ যখন চরমে পৌঁেছ তখন কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার এক জেলে পরিবারের বাক প্রতিবন্ধি মেয়ে বাসন্তিকে জাল পরিয়ে লজ্জা নিবারণের ছবি প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। সেসময় সাজানো নাটকের এই বহুল আলোচিত ছবি তৎকালিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছিলো।
স্বাধীনতা বিরোধিরা শঠতার আশ্রয় নিতে থাকে। বাংলার স্বাধীনতাকে যারা মেনে নিতে পারেনি তারা তখনো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ ভাবতো। এদিকে দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। উপায়ন্তর না দেখে বঙ্গবন্ধু সারা দেশে লঙ্গরখানা খুলে দিয়ে হতদরিদ্র মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেসময় দলীয় কিছু চোর- ছ্যাঁচোড় নেতা-কর্মী তার উপরও ভাগ বসায়। তাইতো তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে আনি আর চাটার দল তা চেটে খেয়ে শেষ করে দেয়। ‘‘ আমি যে দিকে তাকাই সেদিকেই শুধু চাটারদল।’’ বর্তমানে করোনাকালেও যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটছেনা তা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরীব অসহায় মানুষের জন্য যে সাহায্য প্রদান করেছেন, এক শ্রেণির নেতা-কর্মি তাতে ভাগ বসিয়েছে। এপর্যন্ত প্রায় ৮৪ জন দলীয় নেতা-কর্মিকে বহিস্কারসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় সেই সকল চোর-ছ্যাঁচোড়দের কাউকে কাউকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট দেনদরবার চলেছে। তাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য দুএকজন দলীয় এমপি আদালত পর্যন্ত ধর্ণা দিয়েছেন বলেও শোনা গেছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ^ব্যাপি করোনা পরিস্থিতির ভয়বহতা উপলব্ধি করে বলেছেন, করোনাভাইরাসের জন্য বিশ^ব্যাপি যে, খাদ্য মন্দা সৃষ্টি হবে তাতে আগামীতে বিশ^ব্যাপি দুভিক্ষ দেখা দিতে পারে। তিনি গত ২০ এপ্রিল ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত জেলাসমূহের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনা কালে এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন,‘ বাংলাদেশে আমরা যদি খাদ্য উৎপাদন করে খাদ্য মজুদ রাখতে পারি তাহলে আমরা দুর্ভিক্ষে পড়বোনা। ”(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১