নওগাঁর রাণীনগরে চলতি রবিশস্য মৌসুমে ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা, বাদাম সহ অন্যান্য শাক-সবজির পাশাপাশি দিনদিন চাষিরা পাতি চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। জৈষ্ঠ্য মাসের আগে এই এলাকার চাষিদের ঘরে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে তেমন কোন বিক্রয় যোগ্য ফসল ঘরে না থাকায় প্রান্তিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষ কিছুটা অভাব-অনাটনেই এই সময়টা পাড় করে। কিন্তু অসময়ের বন্ধু হিসেবে খ্যাত অধিকাংশ কৃষকদের ঘরে এখন পাতি কাটা ও শুকানোর কাজ শুরু হয়েছে। বাজার মূল্য ভাল ও ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে পাতি চাষি কৃষকরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে তেমন কোন ক্ষতি না হওয়ায় এবং স্বল্প পরিমাণ বালাই নাশক প্রয়োগে, সার্বিক উৎপাদন ব্যয় কম এবং লাভ বেশি হওয়ায় ইরি-বোরো ধান চাষের আগ্রহ কিছুটা কমিয়ে বনপাতি ও জলপাতি চাষে কৃষকরা মনোযোগ দিচ্ছে।
এক সময় এই জনপদে পাতি চাষ তেমন না হলেও পাতি দিয়ে তৈরি পরিবেশ বান্ধব মাদুরের প্রধান উপকরণ হিসেবে কদর বেশি থাকায় চলতি মৌসুমে অন্যান্য ফসলের সাথে রেকর্ড পরিমাণ পাতি চাষ করেছে এই উপজেলার কৃষকরা। ইতিমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে পাতি ভাল হওয়ায় কৃষকরা কাটা শুকানো শুরু করাই ভাল দামে বাজারে পুরোদমে বিক্রয় হচ্ছে। সরকার পর্যায় থেকে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন ফসল চাষের জন্য কৃষি উপকরণ, বীজ, রাসায়নিক সার বিনা মূল্যে বিতরণ করা হলেও পাতি চাষের জন্য প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের কোন প্রকার সহযোগীতা প্রদান করা হয় না। চলতি রবিশস্য মৌসুমে কোন প্রকার প্রাকৃতিক দূর্যোগ হানা না দেওয়ায় পাতি চাষের পরিবেশ অনুকূলে থাকায় পাতির ভাল ফলন হচ্ছে বলে চাষিরা জানান। ইতিমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা নিজ নিজ জমিতে প্রথম পর্যায়ের কাটার কাজ প্রায় শেষ। এই ফসলটি একই জমিতে প্রায় তিন বার কাটা যায়। গ্রামীণ জনপদের কৃষকরা এই পাতি চৈত্র মাস থেকে বৈশাখ মাস অবদি কাটা শুকানোর কাজ চলতে থাকে। মাদুর তৈরির উপযোগী করতে ভাল রোদ থাকলে প্রায় দুই দিন সময় লাগে তা শুকাতে। এরপর কিছু কৃষক সাংসারিক প্রয়োজনে বাজার জাত করলেও বেশি লাভের আশায় অধিকাংশ কৃষক গুদাম জাত করে রাখে। দাম বেশি হলে সুযোগ বুঝে তারা অবসর সময়ে পরিবারের সবাই মিলে মাদুর তৈরি করে বেশি দামে বাজারে বিক্রয় করে। এর সুবাদেই রাণীনগরের পাতি দেশ জুড়ে খ্যাতি।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নে প্রায় ৮০ হেক্টর জমিতে বনপাতি ও জলপাতি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চলতি বছরে উপজেলায় লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে পাতির আবাদ হয়েছে। শুরুতেই ভাল আবহাওয়া অনুকূলে থাকা এবং পাতির ক্ষেতে রোগ-বালাই না থাকায় ও মাঠ পর্যায়ে পাতি চাষিদের উপ-সহকারি কৃষি অফিসাররা যথা সময়ে উপযুক্ত পরামর্শ নজরদারি ও প্রত্যক্ষ কারিগরী সহযোগিতার কারণে পাতি ক্ষেত অনেকটা ভাল হয়েছে। তবে মিরাট, গোনা, কাশিমপুর, রাণীনগর সদর, কালীগ্রাম ও পারইল ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি পাতি চাষ হয়েছে। পাতি কাটার মৌসুমে রোদ ভাল থাকলে মানসম্পূর্ণ ভাবে শুকাতে পারলে প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৭০ হাজার টাকার পাতি বিক্রয় হবে।
উপজেলার পারইল ইউনিয়নের বোদলা গ্রামের পাতি চাষি হেলাল মন্ডল জানান, আমি প্রতি বছরই ধানের পাশাপাশি পাতি চাষ করি। চৈত্র মাস থেকে শুরু করে ইরি ধান ঘরে তুলার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত পাতি বিক্রয় করে আমার সংসারের প্রয়োজনীয় সমস্যা গুলো সমাধান করি। চলতি মৌসুমে এক বিঘাতে পাতি চাষ করেছি। ইতিমধ্যেই প্রথম কাটা শেষ করে পাতিগুলো রোদে শুকানোর কাজ চলছে। আবহাওয়া ভাল থাকায় জমিতে পাতি ভাল হয়েছে। আশা করছি সমদয় খরচ বাদ দিয়ে প্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভের আশা করছি।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪/৫ টি ইউনিয়নে বিগত বছরের তুলনায় লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমান পাতি চাষ হয়েছে। কুটির শিল্পের মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণ পাতি। পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় লাভ বেশি হওয়ার কারণে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি পাতি চাষ করেছে। তবে প্লাস্টিকের সামগ্রী বাজারে বেশি সয়লাভ হওয়ার কারণে পরিবেশ বান্ধব পাতির তৈরি মাদুর কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বছরে উপজেলায় ভাল মানের পাতি হয়েছে।