‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’

মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই আমার মরহুম দাদী-নানীর কথা মনে পড়ে। বাবা-মার স্মৃতি রোমন্থন করতে যেয়ে ঘুরেফিরে আমার কিশোর বয়সে তাদের দু’জনের সাথের অনেক স্মৃতি আমাকে নাড়া দেয়।
কিশোর বয়সে গ্রামের মেঠো পথে ছুটে চলা, গাছে চড়ে আম জাম পিয়ারা খাওয়া এসব কি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আর থাকবেনা-!
স্বাধীনতার আগে যখন আব্বার র‌্যালি সাইকেলের পিছনের সিটে বসে গ্রামে (মাঝগ্রাম, লালপুর) যেতাম তখন চাচাতো ভাইদের সাথে ছুটে বেড়ানো আর খেলাধুলা করার মজাটাই ছিল অন্যরকম।

এখন খালি পায়ে হাঁটার সেই রাস্তা কমে যাচ্ছে। গ্রামেও পাকা সড়ক। মানব দেহ মাটির সাথে স্পর্শ আর পায়না। সেই মাটির ঘর এখন সহজে চোখে পড়েনা। মাটির মেঝেতে সাধারন শপ বিছিয়ে ঘুমানো, সে কি নিবিড় ঘুম-! এখন ফোমের তুলতুলে বিছানার সাথে ফেলে আসা ঘুমের আদৌ কি কোন তুলনা চলে-?

এসবই কি নতুন করে ভাবতে শেখালো করোনা-? বৃষ্টি হলে গ্রামের বাড়ির সামনের স্কুল মাঠে কৈ-মাগুর মাছের কিলবিলিয়ে নড়াচড়া। আর কিশোর বয়সে সেগুলো হাত দিয়ে ধরতে যেয়ে কাঁটা খাওয়া। তারপর শরীরে জ্বর। দাদীর তুলসি পাতা আর শিউলি পাতার রসের থেরাপিতে পরদিনই ভাল হয়ে যাওয়া। কত মধুর স্মৃতি প্রকৃতির সাথে-!
সবই হারিয়ে গেছে। করোনার থাবা যেন আবার মানবকূলকে সবকিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে।

স্বাধীনতার আগে থেকে প্রায় পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত আব্বা-আম্মার সাথে মাঝেমাঝে মামাদের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার বাস্তপুর গ্রামে বেড়াতে যেতাম। বিশেষ করে শীতের শুরুতে পিঠা খাওয়ার দাওয়াত। নানী বেঁচে ছিলেন, খুব আদর করতেন। নানী ছিলেন খুব সুদর্শনি ও কৌতুকপ্রিয় মানুষ। মজার মজার কথা বলতেন।
দুই মামার বাড়ি ছিল বেশ বড় আঙ্গিনা নিয়ে। ঘরগুলো ছিল বড় বড়। সিঁড়ি বাঁধানো অনেক উঁচু, মোটা মাটির দেয়াল, ছোনের ছাউনি। ঘরের চতুর্দিকে ঘোরানো বারান্দা। আটচালা ঘর ছিল। বাড়ির সাথেই আম জাম কাঁঠাল পিয়ারা প্রভৃতি ফলের গাছ। খেজুর গাছের কোন অভাব ছিলনা।
তখনো বিদ্যুত যায়নি এসব গ্রামে। বিকেলে বারান্দায় শপ বিছিয়ে বিশ্রাম নিতেন মুরুব্বিরা। বাতাস শীতল করিয়ে দিতো পরিবেশ। আমরা কিশোর বয়সীরা খেলা করতাম বিরাট আঙ্গিনায়। ডাঙ্গুলি-মার্বেল খেলা ছিল অন্যতম। এছাড়াও ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর মজা।
সন্ধ্যায় খেজুর রস পান করার মজাই ছিল অন্যরকম। খেজুরের গুড় তৈরির সময় সেখান থেকে তুলে নানী-মামী মুড়ির সাথে মেখে খেতে দিতেন। কি অপূর্ব স্বাদ ছিল। নির্ভেজাল খেজুরের গুড় মাটির হাঁড়িতে ভরে বাড়ি ফেরার সময় সাথে দিয়ে দিতেন মামারা। গরম রুটির সাথে এই গুড় খাওয়ার স্বাদ এখনো অনুভব করি। রুটি তৈরির সময় তখন যে সুন্দর একটি ঘ্রান বের হতো এখনকার আটায় তার কিছুই পাওয়া যায়না।
সেইসব গ্রামও পরিবর্তন হয়ে গেছে। রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। অধিকাংশ মাটির সেই দর্শনীয় বাড়ি-ঘর নেই, উঠেছে দালান। কাটা পড়েছে অনেক বড় বড় গাছ-গাছালি। পঁচাত্তর সালের আগের সেই চিরচেনা বাস্তপুর গ্রাম এখন আর নেই।

গ্রামটির পাশ দিয়ে গেছে পাকা সড়ক, তার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নদী। এর ওপাশেই ভারত।
এই নদীতে আব্বা ও ছোট মামা হুইল-বরশি দিয়ে মাছ ধরতেন। প্রচুর মাছ ছিল নদীতে। বরশিতে মাছ উঠলে খুব মজা লাগতো আমার। আনন্দে নাচানাচি শুরু করতাম। আহা! কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব দিন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা এই গ্রামেই ছিলাম নয় মাস। বড় ভাই, সেজ ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন ভারতে অনেক আগেই। মেজ ভাই পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ছিলেন। ছুটি নিয়ে এসে আর যাননি পশ্চিম পাকিস্তানে। একাত্তরের জুন মাসের দিকে তাকে পাকসেনারা গ্রেফতার করে অনেক বাঙালির সাথে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখে।
আমিই ছিলাম তখন আব্বা-আম্মার সঙ্গি, অন্যরা ছোট।
ছোট মামার বাড়ির পাশেই ছিল কালাম রাজাকারের বাড়ি। একে নিয়েই ছিল আমাদের যত ভয়। তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে, ওরা জানতো। ফলে ও কখন পাকসেনাদের কাছে বলে দেয় এই নিয়ে আব্বা দুশ্চিন্তায় থাকতেন।

এতসবের মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় কামলা বেশে ছয়জন যুবক আসলো এখানে মামার বাড়িতে। উল্লেখ্য, এই গ্রামের এক প্রান্তের প্রথম বাড়িই ছিল এটি। তখন ধান কাটার সময়। এভাবে গ্রামে ধানকাটা শ্রমিক আসা-যাওয়া করতো। সন্ধ্যা হলেই আব্বা তাঁর প্রিয় রিভলবারটি সাথে রাখতেন। ওদের মধ্যে একজন আব্বার সাথে একটু দুরে বাড়ির ভিতরে কথা বললো। এরপর আব্বা তাদের থাকতে দিতে রাজি হলেন। কি কথা হয়েছে তা অবশ্য তখন তিনি কিছুই বললেননা। রাতে মামা তাদের জন্য খিচুড়ি রান্না ও তাদেরকে বৈঠকখানায় থাকার ব্যবস্থা করলেন। হঠাৎ ভোরে বিকট শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আব্বা মামাসহ সকলকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘তোমরা কেউ চিন্তা করোনা। নদীর সংযোগ ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছে, সেটারই শব্দ হলো’। আসলে কামলাবেশি ওই ছয়জন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ওরা দায়িত্বটি পালন করে সকাল হওয়ার আগেই আবার ভারতে চলে গেছে।

এখানে আরো একটি মজার ঘটনা ছিল। ওই গ্রামের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এক বয়স্ক হাজী সাহেব, আজিবার প্রামানিক। আব্বাকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। মামাদের বাড়ির খানিকটা দুরে ছিল উনার বাড়ি। মাঝেমধ্যে তিনি হাঁটতে হাঁটতে আসতেন গল্প করতে।
একদিন তিনি আব্বার কাছে প্রস্তাব দিলেন যুদ্ধ শেষ হলে বড় ভাইয়ের সাথে উনার মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য। আব্বা কৌশলে এটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে প্রস্তাবটা ভাল। আগে যুদ্ধ শেষ হোক তারপর এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে। এই অস্ত্রে ভাল কাজ হয়েছিল। তাঁর খবরদারির কারনে কালাম রাজাকার আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। অবশ্য হাজ্বী আজিবার প্রামানিক গ্রামে কখনো পাকসেনাদের আসতে দেননি অথবা কারো ক্ষতিও হতে দেননি। উনাকে আমরা অন্যদের মত কোন অপকর্মের সাথে যুক্ত হতেও দেখি নাই।

দর্শনা, সুলতানপুর প্রভৃতি গ্রামে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন আছে। আব্বা জীবিত থাকা পর্যন্ত এসব জায়গায় যাতায়াত ছিল। আমি তাদের অধিকাংশকেই চিনিনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্যা হয়েছিল। দর্শনার আত্মীয়রা আমাদেরকে একটি ডিঙ্গি নৌকা বানিয়ে দিয়েছিল। আমার এক মামাতো ভাই ছিল শওকত, আমরা সমবয়সী। এক সাথে এই নেীকায় ঘুরে বেড়াতাম, মাছ ধরতাম। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত তখন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ফলে মাছের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছিল মানুষজনের। আমার সেই প্রিয় বন্ধুর মত মামাতো ভাই শওকত চার বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

কি এক পরিবর্তন ঘটে গেল বিশ্বজুড়ে-! সবকিছু ওলোট-পালোট। ভেঙ্গে গেছে অর্থনীতি, পাল্টে গেছে মানবজীবন। কোথা থেকে এসে যুদ্ধে নামলো ‘করোনা ভাইরাস’ নামের মহাশক্তিধর এক অদৃশ্য দানব।
যে যুদ্ধে গুলি, বোমা, রকেট লঞ্চার, এমনকি কোনো পরমাণু অস্ত্রও কার্যকর হয় না। অথচ যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষ ‘কোভিড ১৯’ তথা নোভেল করোনাভাইরাসটির মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিরস্ত্র মানুষকে ।

অবশ্য ঠিক নিরস্ত্র নয়। সাবান পানি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, অক্সিজেন, আর পরীক্ষামূলকভাবে কিছু প্রচলিত ওষুধ নিয়ে ওই অসম যুদ্ধটি স্থায়ী অস্থায়ী হাসপাতালে লড়তে হচ্ছে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীকে।

দেশে দেশে যুদ্ধ করতে, রাজনৈতিক আধিপত্য পেতে বড় বড় সন্ত্রাসী বাহিনি বানিয়ে তাদেরকে ব্যবহার আর অস্ত্র বিক্রির জন্য অজ¯্র অর্থ বিনিয়োগ করা; এসবই বিশ্ব শক্তিধর দেশগুলোর কর্মকান্ড। ওরা মানুষের জীবনকে গুরুত্ব দেয়না, ওরা জীবন রক্ষায় খরচ করে কম। যুদ্ধের নামে শত শত টন বোমা ফেলে ক্ষতবিক্ষত করে পৃথিবীর বুক, ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা করে সমুদ্রের পানিতে। বনাঞ্চল কেটে অট্রালিকা বানায় আধুনিক হতে। বিশাল বিশাল সুউচ্চ ভবন যেন আকাশ ছোঁবে। এতো ভার কি করে সইবে পৃথিবী-? এক সময় সব কিছু তার বুক থেকে ফেলে দেবে নাতো?

এখন চলমান এই ভাইরাস জ্বরে নানী-দাদীদের সেই তুলসি ও শিউলি পাতার রসের থেরাপিতেই তো আবার ফিরে যেতে হচ্ছে। মানব শরীরও কেমন যেন হয়ে গেছে। কৃত্রিম জিনিসপত্র খেতে খেতে সেই প্রকৃতি-পরশের দেহটি আর মানুষের নেই। কত রকমের ভাইরাসে কাবু করে ফেলছে সহজেই। আমরা কি আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো-? সৃষ্টির সেরা জীব যখন; তখন তো আমাদের আবার ফিরতে হবে, পিছনে তাকানোর সুযোগ নেই। কিন্তু শক্ত জীবন গড়তে আবার প্রয়োজন প্রকৃতি নির্ভর জীবন প্রনালী। সেই শিক্ষার অনেক কিছুই তো নেয়া যায় দাদী-নানীদের ফেলে যাওয়া জীবন প্রনালী থেকে। অতীত দিনগুলো ছিল অ¤ø-মধুর স্মৃতি জড়ানো। তারপরও কেন জানি কবিগুরুর সেই কবিতার লাইনটি মনে পড়ে, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’। ( লেখক: ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক, কলাম লেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।