মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর সময় থেকেই ভারতে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইসলামের ইতিহাস হতে জানা যায় ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক জোসনা রাতে ভারতের চন্ডিগড়ের রাজা চেরমন পরিমল রামা ভরমা ছাদে বসে চাঁদের আলোয় অবগাহন করছিলেন। হটাৎ রাজা দেখলেন চাঁদটি দুখন্ড হয়ে গেলো এবং আবার তা একত্র হলো। এ ঘটনায় তিনি হতবিহবল হয়ে রাজ জ্যোতিষীকে তলব করে কারণ জানতে চাইলেন যে, চন্দ্র দেবতার এ দশা হলো কেন? রাজ জ্যোতিষী সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলেন। ঘটনাচক্রে একদল আরব ব্যবসায়ী তার রাজ্যে উপস্থিত হলে তিনি কথা প্রসঙ্গে সেদিন রাতের অভাবনীয় ঘটনা বর্ণনা করেন। তারা রাজাকে নবী করিম (সা.) এর সঙ্গে ঘটে যাওয়া আরবের ঘটনার বিবরণ দিলেন। কিভাবে সেখানে অসংখ্য মানুষের সামনে চাঁদ দ্বিখন্ডিত করেন এবং তা আবার জোড়া লাগিয়ে দেন।
এরপর রাজা রাজ্য ত্যাগ করে পবিত্র মক্কায় গিয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হজরত তাজ উদ্দিন আহমদ। ৬২৯ সালে মহা নবী (সা.) এর জীবদ্দশাতেই ভারতে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। হজরত তাজ উদ্দিন আহমদ (রা.) এর নির্দেশে কেরলের ত্রিসুর জেলায় সাহাবী হজরত মালেক বিন দিনার(রা.) সেই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তখন থেকেই সেই মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন মাঠে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো।
ভারতবর্ষে মুসলমানের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু প্রধান দেশ হওয়ায় সেখানকার সংখ্যালঘিষ্ট মুসলমানেরা কোনঠাসা অবস্থায় থাকে। হিন্দুয়ানি রীতি-নীতিতে তারা নিজেদের ধর্ম রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলিম স¤্রাট, রাজা-বাদশাহগণ সুদীর্ঘকাল সা¤্রাজ্য শাসন করে।
ঘটনার পালাবদলে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা এদেশ নিজেদের করাত্ব করে নেয়। মুসলিম সম্প্রদায় তাদের ধর্মের প্রতি অবিচল থাকলেও কালক্রমে ধর্মীয় মুল রীতি নীতির অনেকটাতেই ভাটা পড়ে।
১৮৮৫-এর দিকে জেমস ওয়াইজ লিখেছিলেন, এদেশের মুসলমানেরা সরল ও অজ্ঞ কৃষক। ইসলাম ধর্মে যেসব বিজাতীয় রীতিনীতি প্রবেশ করেছিলো তা এখন উৎপাটন করতে চাইছে। তাতে মনে হচ্ছে কৃষকরা এর পথ খুজে পাচ্ছেনা। লাক্ষ্য নদীর তীরে কোরবানির ঈদের সময় গ্রামবাসিরা জমায়েত হয়েছেন ঈদের নামাজ পড়বেন বলে। কিন্তু জামায়াতের একজনও জানতেননা কিভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়।
ইংরেজরা একসময় ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশের সুচনা হয়। তখন থেকে ভারতের মুসলমানদের জন্য ইসলাম ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে দারুন বাধার সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় এবং তারা মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের সুচনা করে। আর তখন থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। সেঅই থেকে ভারতের মুসলমান অবাধে তাদের ধর্ম পালন করে থাকে।
ভারতের মত প্রাচীন বাংলাদেশে অর্থাৎ আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর সময় থেকেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশের ইসলামের ইতিহাস হতে জানা যায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিলো ৬২০ খিস্টাব্দে। লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামের ‘ মজেদের আড়া ’ নামক জঙ্গলে ১৯৮৭ সালে আবিষ্কিৃত হয় একটি প্রাচীন মসজিদের ধংসাবশেষ। জঙ্গলটি খনন করে একটি ইট পাওয়া যায়। এতে কালেমা তায়্যিবা ও ৬৯ হিজরী লিপিবদ্ধ ছিলো। হিজরী ৬৯ মোতাবেক ৬৯০ খ্রিস্টাব্দ। রংপুর জেলার ইতিহাস হতে জানা যায় রাসুল (সা.) এর মামা অর্থাৎ তাঁর মায়ের চাচাতো ভাই হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০-৬২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। অনেকে অনুমান করেন যে, ৬৯০ খ্রিস্টাব্দের মসজিদটি হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মাণ করেন। আর এ থেকে অনুমান করা হয় যে, বাংলার মুষ্টিমেয় মুসলমান তখন থেকেই সেই মসজিদে নামাজ আদায় করা শিক্ষা করেন এবং সেই সাথে ঈদের নামাজ ও আদায় করতেন।
বাংলার মুসলমানরা আগাগোড়াই মুসলিম রীতি নীতি জাকজমকভাবেই পালন করতো। বাংলার শাসনকর্তা দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁর সময় (১৭২৯) জয় করা হয়েছিলো ত্রিপুরা। ২৯ রমজান নবাব এখবর পেয়ে এতো উল্লসিত হলেন যে, তিনি যেন দুটি ঈদ পালন করছেন। ঈদের দিন একারণে তিনি মীর সৈয়দ আলী ও মীর মোহাম্মদ জামানকে আদেশ দিলেন গরিবদের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করতে। ঢাকা কিল্লা থেেেক এক ক্রোশ দুরে ঈদগাহ যাবার পথে রাস্তায় ছড়ানো হয়েছিলো সেই মুদ্রা। ১৯৪৭ সালের আগে একমাত্র ঢাকাতেই ঈদ যা একটু ধুমধামের সাথে পালিত হতো। ঢাকা ছিলো পুর্ববঙ্গের প্রধান ও মুঘল শহর। তাই মুঘল ঈদের প্রভাব ছিলো বেশি। সেসময় ঈদের দিন শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো। হাতি উট, পালকি এক বহরে চলতো। সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েবে নাযিম। কিংখাবের ছাতি হাতে ছাতি বরদার, বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ছিলো কাড়া-নাকাড়া ও শিংগা।
ঢাকায় রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিলো খাবার। প্রতি বারের ন্যায় রমজানের চাঁদ দেখার পর এবারে ২৫ এপ্রিল থেকে রোজা পালন শুরু হয়। বিশ^ ব্যাপি করোনাভাইরাসের মধ্যেই বাংলাদেশে সংক্রমণ রোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। নিরাপদ শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই অবস্থান করতে বলা হয়। তাই চকবাজারের ঐতিহ্যবাহি ইফতারির বাজারও এবার বন্ধ থাকে। শত শত বছরের ঐতিহ্য পুরান ঢাকার এই ‘ বড় বাপের পোলায় খায় ’ খাবারটি মানুষের মুখে মুখে। কথিত আছে প্রায় ১শ ২৭ বছর আগে কালেম মিয়া নামক এক বাবুর্চি এই খাবার তৈরি করেছিলেন। এরপর বংশানুক্রমে তার ছেলে আলম থেকে সালেকিন মিয়ার হাত পেরিয়ে এখন এই খাবার চকবাজার ইফতারি মার্কেটে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বিক্রি করে থাকে। খাবারের মধ্যে আরো ছিলো শিরমাল, বাকেরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হাড্ডি কাবাব, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবারে বিশ^জুড়ে করোনা মহামারির মধ্য দিয়েই হয়ে গেলো ঈদ। শুধু কি তাই? ঈদের মাত্র কদিন আগে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে স্মরণকালের ভয়াবহ আমফান আঘাত হানে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ টি জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েটি জেলায় ঘুর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।