১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ আত্মপ্রকাশ করে । সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কেন জাসদ নামের দলটি প্রতিষ্ঠিত হলো, কারা দলটি প্রতিষ্ঠা করলেন – তা হয়তো এই প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। দলটি নিয়ে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রতিক্রিয়া এখনো বিদ্যমান। এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে, বাঙালী যারা পাকিস্তানী সমর্থক ছিলেন, তারা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরুতে হতাশ হলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র চারমাসের মধ্যে বাংলা এবং বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী ছাত্রলীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে ছাত্রলীগ থেকে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ যা পরে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। এরপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তেইশ বছরের শাসনাকালের অবসান হয়। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ঠিক চারমাসের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মতবাদ আর মতভেদকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়। সেই বিভেদ থেকে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয় জাসদ।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের প্রধান দুই নেতা সিরাজুল আলম খান এবং শেখ ফজলুল হক মনি’র মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠে। মতবাদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুই নেতার মধ্যে ব্যাপক দুরত্বের সৃষ্টি হয়। এক গ্রুপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষনা এবং আরেক গ্রুপ মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান গ্রহন করেন। উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মতবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করে। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ২৬ মার্চ রেডিও ও টেলিভিশন ভাষনে বলেছিলেন, আমার সরকার আভ্যন্তরিন সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। আমার সরকার বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই ভাষনে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেন। সেই থেকে সিরাজুল আলম খান এর সমর্থকরা বলতে থাকেন, আমরা লড়ছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শ্রেনী সংগ্রামকে তরান্তিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যেমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। অপরদিকে শেখ ফজলুল হক মনি’র সমর্থকরা এটা হটকাবী অতিবিপ্লবীদের প্রতিহত করে মুজিববাদ কায়েম করার ঘোষনা দেন।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের আগেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের প্রধান চার নেতার মধ্যে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদের সাথে শেখ ফজলুল হক মনি’র বিরোধ ছিল। অনুরূপ ছাত্রলীগের চার খলিফা নামে খ্যাত ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব এবং ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ছিলেন সিরাজ সমর্থক আর ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন ছিলেন শেখ মনি’র সমর্থক। স্বাধীনতার পরে যার প্রভাব একইভাবে পরিলক্ষিত হয়।
১৯৭২ সালে ২০ মে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ পাল্টাপাল্টি প্যানেল দেয়। সিরাজ পন্থীরা ভিপি জিনাত আলী ও জিএস পদে মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশকে প্রার্থী করে। অপরদিকে শেখ মনি সমর্থকরা শেখ শহিদুল ইসলামকে ভিপি এবং মনিরুল হক চৌধুরীকে জিএস পদে মনোনয়ন দেয়। উক্ত নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুইটা প্যানেল থাকায় ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং মাহবুব জামান যথাক্রমে ভিপি এবং জিএস পদে বিজয়ী হন। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার শুরু হয়। সিরাজ সমর্থকরা নুরে আলম সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেন । অপরদিকে শেখ মনি সমর্থকরা শাজাহান সিরাজকে বহিষ্কার করে ইসমত কাদির গামাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। পরিশেষে ছাত্রলীগের বিভক্তি চুড়ান্ত হয় জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে।
১৯৭২ সালের ২১-২৩ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারন হয়। সিরাজ সমর্থক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থীরা পল্টন ময়দানে স্থান নির্ধারন করেন। আর শেখ মনি সমর্থক মুজিববাদ পন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থান নির্ধারন করেন। উভয় গ্রুপ প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করেন। উভয় গ্রুপই নিশ্চিত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাদের সম্মেলনে আসবেন। অবশেষে ২১ জুলাই বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে না এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুজিববাদ পন্থীদের সম্মেলনে যান। মূলতঃ সেদিনই দল বিভক্ত চুড়ান্ত হয় । পল্টন ময়দানে তিনদিনব্যাপী সম্মেলন শেষে সিরাজ পন্থীরা শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি এবং আফম মাহবুবুল হককে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত করেন।
ছাত্রলীগ বিভক্তির পর আগষ্ট – সেপ্টেম্বর – অক্টোবর এই তিনমাসে সঙ্কট সমাধানতো দুরের কথা সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। সিরাজুল আলম খানের পক্ষ আলাদা দল গঠনের অভিমত প্রকাশ করেন। সেই থেকে নুতন দল গঠনে নেতৃত্ব গ্রহন নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। প্রথম শোনা যায়, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. আলীম আল রাজী’র নাম। তারপর শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর নাম। কারন তাজউদ্দিন আহমেদ তখন আওয়ামী লীগের কাছে কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন। স্বাধীন হওয়ার একমাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক পদ থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি স্বাধীনতার পর তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রী হতে হয়। ( পরে দলীয় কোন্দলে মন্ত্রী থেকেও বাদ পড়েন) কথিত আছে জাসদ গঠনের আগের রাতে সিরাজুল আলম খান এবং আসম আব্দুর রব উনার মন্ত্রী পাড়ার বাসভবনে সারারাত বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমেদ এর সাথে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর এলাকার নেতা ময়েজ উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, রহমত আলী ও রিয়াজুল ইসলাম। উক্ত বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমেদ প্রথমে নেতৃত্ব গ্রহনে রাজী থাকলেও শেষ মুহূর্তে উনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। উনি শেষ মুহূর্তে বলেন, আমার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দল করা সম্ভব নয়। পরে আর কোনভাবেই তাঁকে রাজী করানো যায়নি। তবে ঐ বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমেদ এর ঘনিষ্ঠ সহচর রহমত আলী নবগঠিত দলে যোগ দেওয়ার ঘোষনা দেন।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে নুতন দল গঠনের লক্ষে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, মেজর এম,এ জলিল, আসম আব্দুর রব, মনিরুল ইসলাম ( মার্শাল মনি), শাজাহান সিরাজ, বিধান কৃষ্ণ সেন, নূরে আলম জিকু, মোশাররফ হোসেন, খন্দকার আবদুল মালেক, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, এম এ আউয়াল, রহমত আলী, হাসানুল হক ইনু এবং শরীফ নুরুল আম্বিয়া। বৈঠকে নব গঠিত দলের নামকরণ হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক মেজর এম এ জলিল এবং আসম আব্দুর রবকে যৌথভাবে আহবায়ক করে, শাজাহান সিরাজ, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নূরে আলম জিকু ও রহমত আলীকে সদস্য করা হয়।
জাসদ গঠন হওয়ার পর জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য খোন্দকার আবদুল মালেক ও সাধারন সম্পাদক হাসানুল হক ইনু সহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জাসদে যোগ দেন। তৎকালীন শ্রমিক লীগের দুই প্রধান নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান এবং রুহুল আমিন ভুঁইয়া জাসদে যোগ দেন। সংসদ সদস্যদের মধ্যে খোন্দকার আবদুল মালেক, মোশাররফ হোসেন, ভোলার ডাঃ আজাহার উদ্দিন, সাতক্ষীরার স,ম আলাউদ্দিন প্রমুখ যোগ দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতান উদ্দিন আহমেদ ও খোরশেদ আলম যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও কর্নেল তাহের সহ একাধিক সাব সেক্টর কমান্ডার জাসদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আসম আব্দুর রব এবং ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষনাকারী ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ নেতাদের নেতৃত্বে নব গঠিত জাসদে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী ( বিএলএফ), এফ,এফ বাহিনীর বেশীর ভাগ জেলা ও থানা কমান্ডারগন যোগ দেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ হলেন, চুয়াডাঙ্গার মির্জা সুলতান রাজা, যশোরের রবিউল আলম, খুলনা বাগেরহাটের কামরুজ্জামান টুকু, কুষ্টিয়ার মারফত আলী, পাবনার মোঃ ইকবাল, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা, বগুড়ার এবিএম শাহজাহান, রংপুরের মোস্ততাফিজুর রহমান মুকুল, সিলেটের আখতার আহমেদ, কুমিল্লার হাবিবুল্লাহ চৌধুরী, নোয়াখালীর মোস্তাফিজুর রহমান, চট্টগ্রামের আহমেদ শরীফ মনির, মাদারীপুরের শাজাহান খান, টাঙ্গাইলের খন্দকার আবদুল বাতেন প্রমুখ।
জাসদের ১ম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কাউন্সিলে মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি এবং আসম আব্দুর রবকে সাধারন সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১১-১৩ মে পল্টন ময়দানে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি মেজর এম এ জলিল সহ-সভাপতি যথাক্রমে বিধান কৃষ্ণ সেন, মোশাররফ হোসেন, মির্জা সুলতান রাজা, সাধারন সম্পাদক – আসম আব্দুর রব, যুগ্ম সাধারন সম্পাদক – শাজাহান সিরাজ, সাংগঠনিক সম্পাদক – নূরে আলম জিকু, প্রচার সম্পাদক – সুলতান উদ্দিন আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক – মাজহারুল হক টুলু, কৃষি সম্পাদক – হাবিবুল্লাহ চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু, অর্থ সম্পাদক – কামরুজ্জামান, তথ্য সম্পাদক – শাহ আলম, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক – মমতাজ বেগম সহ ৫৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। জাসদ অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করে।
জাসদ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনদের দমন পীড়ন মারাত্মক আকার ধারণ করে। জাসদ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ১২ নভেম্বর ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার মুজিব বাহিনী প্রধান সিদ্দিক মাষ্টার খুন হন। প্রকাশ্যে খুন করা হয় ঈশ্বরদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান কচিকে। শাহজাদপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলালুজ্জামান হেলাল সহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। যশোরে খুন হন, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি সাবেক সাংসদ মোশাররফ হোসেন। মানিকগঞ্জ জেলা জাসদের যুগ্ম আহবায়ক সাদত হোসেন রবিনকে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস বোরহান উদ্দিন রোকন সহ শত শত নেতাকর্মী এই সময়ে খুন হয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার ছাতারপাড়া গ্রামে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হন, শামসুল হাদী, মুসা, উম্মত, খলিল, জিলানী, কুদ্দুস, মন্টু সহ ৭ জন। পাবনায় খুন হয় ফারুক, কানু, শেখর, বাদশা, রফিক, স্বপন সহ অনেকে। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে জাসদ গনবাহিনী গঠন করে। জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাজাহান গনবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার নিযুক্ত হন। কর্নেল তাহের ফিল্ড কমান্ডার এবং হাসানুল হক ইনু ডিপুটি কমান্ডার নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে যেতে হয়েছিল। জাসদ রাজনীতিতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মী জীবন দেয়। ১৯৭২ সালে জাসদ রাজনীতির উত্থান পর্ব বলা হলেও ৭৫ পরবর্তী সময়কাল হলো বেশী দুর্যোগপুর্ন। ৭৬ সালে কর্নেল তাহের এর ফাঁসি দেওয়া এবং সমস্ত শীর্ষ নেতাদের জেলে থাকার কারনে জাসদের সাংগঠনিক শক্তি নিম্নমুখী হতে থাকে।
জাসদ রাজনীতির ভাঙ্গন পর্ব শুরু হয় ১৯৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর। ঐদিন জাসদের সম্বন্বয় কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। গণবাহিনী বিলুপ্ত করা হয়। যদিও তখন সামরিক শাসনের কারনে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। জাসদ নানা প্রতিকুলতার মধ্যে স্বাভাবিক রাজনীতি করতে চেয়েছে। ১৯৭৩ সালে ৭ মার্চ ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই শতকের বেশি আসনে প্রার্থী দিলেও একটি আসনে নির্বাচিত হয় টাঙ্গাইলের আব্দুস সাত্তার। পরে উপ নির্বাচনে রাজশাহী থেকে মইন উদ্দিন মানিক নির্বাচিত হয়। চাঁদপুর থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচিত সদস্য আবদুল্লাহ সরকার জাসদে যোগ দিলে ১ম সংসদে জাসদের তিনজন এমপি হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করলে একমাত্র দল জাসদ যোগদান থেকে বিরত থাকে। তবে ৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১ জন টাঙ্গাইলের আব্দুস সাত্তার বাকশালে যোগদান করেন। জাসদের অন্য দুইজন যথাক্রমে মইন উদ্দিন মানিক এবং আবদুল্লাহ সরকার বাকশালে যোগ না দেওয়ায় তাঁদের সদস্য পদ বাতিল হয় এবং জাসদকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ২য় সংসদ নির্বাচনে জাসদ ৮ টি আসনে জয়লাভ করে। তখন সিরাজুল আলম খান, মেজর এম এ জলিল সহ একাধিক নেতা জেলে ছিল। দলের সাধারন সম্পাদক আসম আব্দুর রব জেলখানায় অসুস্থ হলে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে জার্মান পাঠানো হয়। এরপর ১৯৮০ সালে সিরাজুল আলম খান, মেজর এম এ জলিল, আসম আব্দুর রব সহ শীর্ষ জাসদ নেতারা জেল থেকে মুক্তি পান। দীর্ঘদিন পর জাসদ পুনর্গঠনের লক্ষে জাসদ, জাতীয় শ্রমিকলীগ, জাতীয় কৃষকলীগ এবং ছাত্রলীগ থেকে ২ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি করা হয়। সম্বন্বয় কমিটির প্রতিনিধিরা হলেন, জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিল ও সাধারন সম্পাদক আসম আব্দুর রব, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাজাহান ও সাধারন সম্পাদক রুহুল আমিন ভুঁইয়া, জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি খন্দকার আব্দুল মালেক ও সাধারন সম্পাদক হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি মুনির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারন সম্পাদক আবুল হাসিব খান। উক্ত কমিটিতে সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম জিকু, মির্জা সুলতান রাজা ও শাজাহান সিরাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৮০ সালে শেষ দিকে আওয়ামী লীগের সাথে জাসদ জোটভুক্ত হলে এর প্রতিবাদে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, মুবিনুল হায়দার, হাবিবুল্লাহ চৌধুরী, আ ফ ম মাহবুবুল হক, ইকরামুল হক, মাহামুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান প্রমুখ জাসদ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদ গঠন করেন। ১৯৮৪ সালে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর এম এ জলিল জাসদ থেকে বের হয়ে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি নুতন দল গঠন করেন। ঐ সালে এরশাদের উপজেলা নির্বাচনকে সমর্থন করে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব, নূরে আলম জিকু আলাদা জাসদ গঠন করেন। এই গ্রুপের পক্ষে থাকেন, সিরাজুল আলম খান। ১৯৮৫ সালে জাসদ আবার ভেঙ্গে যায়। মির্জা সুলতান রাজা এবং শাজাহান সিরাজ আরেকটি জাসদ গঠন করেন। এমতাবস্থায় জাসদের অন্য গ্রুপ কাজী আরেফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু এবং শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ নেতারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই সময়ে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সভাপতি পদ বিলুপ্ত করে সাধারন সম্পাদক নিয়ন্ত্রিত দলের কাঠামো করেন। হাসানুল হক ইনু সাধারন সম্পাদক হন এবং কাজী আরেফ আহমেদ সভাপতি মন্ডলীর ১ নং সদস্য হন।
৯০ পূর্ববর্তী সময়ে জাসদে আরো ছোট ছোট ভাঙ্গন হয়েছে। জাসদ ( আউয়াল), জাসদ ( মহিউদ্দিন) উল্লেখ করা যায়। এই সময়কালে দলীয় কর্মকান্ডে হতাশ হয়ে অনেকে দল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দলের মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীরা জাসদ ত্যাগ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। এমন অনেক নেতাকর্মী জাসদ ত্যাগ করে ঐসব দলে এমপি বা মন্ত্রী হয়েছে। বিগত সময়ে জাসদ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেওয়া উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ, গৌতম চক্রবর্তী, রেদোয়ান আহমেদ, খুলনা জেলা জাসদের সভাপতি শেখ রাজ্জাক আলী ( সাবেক স্পিকার), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা জাসদ ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি সাইফুর রহমান, ঢাকা কলেজের ভিপি জিয়াউল হক ফারুক, ঢাকা সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভিপি জামাল উদ্দিন, জাসদের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি এহসান আলী খান, জাসদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হারুনুর রশীদ, কুমিল্লার আবুল কাশেম ( সাবেক মন্ত্রী), সাতক্ষীরার শেখ আনসার আলী প্রমুখ।
জাসদ থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া নেতারা হলেন, শ্রমিক লীগের সাধারন সম্পাদক রুহুল আমিন ভুঁইয়া, বরিশালের রুহুল আমিন হাওলাদার, ডাকসুর জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু, বাম্মনবাড়ীয়ার সাবেক মন্ত্রী হুমায়ুন কবির, বগুড়ার সাবেক মন্ত্রী এবিএম শাহজাহান, ঢাকা সিটির সাবেক ডিপুটি মেয়র আব্দুস সালাম, জাসদ থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি যথাক্রমে ঝিনাইদহের গোলাম মোস্তফা ও রাজবাড়ীর আবদুল মতিন মিয়া, পটুয়াখালীর আব্দুর রশিদ, বরিশালের আবদুল বারেক, সিলেটের মকসুদ আজিজ ইবনে লামা, পাবনার প্রধান জাসদ সংগঠক ও সাবেক এমপি মোঃ ইকবাল প্রমুখ। কথিত তথ্যে জানা যায়, এরশাদ সরকারের সময় জাতীয় পার্টির ৭০ জনের বেশী এমপি ছিল যারা জাসদের মাঠ পর্যায়ের নেতা এবং সংগঠক।
জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে ফিরে যাওয়ার তালিকা সেটাও দীর্ঘ -। উল্লেখযোগ্যরা হলেন, জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি ও সাবেক সভাপতি মির্জা সুলতান রাজা, মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন, কাজী আরেফ আহমেদ এর সহধর্মিণী রওশন জাহান সাথী, কর্নেল তাহের এর ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মাদারীপুরের জেলা গণবাহিনীর কমান্ডার সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, টাঙ্গাইল জেলা গণবাহিনীর কমান্ডার খন্দকার আবদুল বাতেন, বৃহত্তর খুলনার গণবাহিনীর কমান্ডার ও বর্তমান বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু, সিরাজগঞ্জের গনবাহিনীর জেলা কমান্ডার ও সাবেক জাসদ দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ মির্জা, ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না ( সাবেক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের প্রধান), ডাকসুর জিএস আখতারুজ্জামান ( সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) প্রমুখ। গত দশ বছরে অসংখ্য জাসদ নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের পদ পদবিতে আছেন।
৯০ পূর্ববর্তী ভাঙ্গন আর নেতাকর্মীদের দলত্যাগে জাসদের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদ ( রব), জাসদ ( ইনু) এবং জাসদ ( শাজাহান সিরাজ) এই তিন গ্রুপ থেকে প্রার্থী অংশ নিলে শুধু শাজাহান সিরাজ গ্রুপ একটি আসনে জয়লাভ করে। অনুরূপ ৯৬ সালের নির্বাচনে শুধু জাসদ ( রব) থেকে আসম আব্দুর রব নির্বাচিত হন। ৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হলে আসম আব্দুর রবকে মন্ত্রী করা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ ( ইনু) এবং মইন উদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে বাসদ এর একাংশ একিভুত হয়ে জাসদ ঐক্যবদ্ধ করেন। ঐক্যবদ্ধ জাসদের সভাপতি আসম আব্দুর রব, কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দিন খান বাদল এবং হাসানুল হক ইনু সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলে সারাদেশে জাসদ সমর্থকদের মধ্যে যেন প্রানচঞ্চলতা ফিরে আসে। জেলায় জেলায় জাসদ কর্মীরা যেন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সেই আনন্দ, সেই উচ্ছ্বাস খুব বেশীদিন স্থায়ী হলোনা। ২০০১ সালে ঐক্যের অপমৃত্যু হলো। বিনামেঘে বজ্রপাতের মত জাসদ আবার বিভক্ত হলো। সৃষ্টি হলো জাসদ ( রব) এবং জাসদ ( ইনু)।
২০০৪ সালে জাসদ ( ইনু) আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দলীয় জোটে শরীক হওয়ায় আবার নিজেদের সংগঠিত করতে পারলেও জাসদ ( রব) আর তেমন অবস্থানে আসতে পারে নাই । যদিও জাসদ ( রব) এর সাথে প্রতিষ্ঠাকালীন অসংখ্য ত্যাগী নেতৃবৃন্দ আছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাসদ ( ইনু) ১৪ দলীয় জোটে থেকে নির্বাচন করে ৩ টি আসন পায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৫ টি আসন পায়। এছাড়া জোট সরকারের মন্ত্রী হন। ৫ জন এমপি এবং ১ জন মন্ত্রী থাকাবস্থায় ২০১৬ সালে জাতীয় সম্মেলনে সাধারন সম্পাদক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল আবার ভেঙ্গে যায়। শেষ বারের দল ভাঙ্গায় তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মনটাও ভেঙ্গে যায়। জাসদের মত দল যার অতীত ঐতিহ্য এবং সংগ্রামী চেতনা আজ ভুলুন্ঠিত। হাজার হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ আজ বিফলে পরিনত হয়েছে।
জাসদ আজ ত্রিধারায় বিভক্ত। জাসদ, জেএসডি এবং বাংলাদেশ জাসদ হিসেবে আলাদা রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় করায় রাজনৈতিক শক্তি এবং গ্রহনযোগ্যতা আজ খন্ডিত। উভয় জাসদের মাঠ পর্যায়ের কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং জাসদ অনুরাগীদের প্রানের দাবী – জাসদ ঐক্যবদ্ধ হোক। জাসদ নামে একটি দল হোক। জাসদ পরিবারের আরেক অংশ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদকেও এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় শরীক করা হোক। হাজার হাজার আত্মবিসর্জনকারী জাসদ কর্মীদের আত্মা এবং ত্যাগের কথা বিবেচনা করে জাসদ ঐক্যবদ্ধ করা দরকার। জাসদের কর্মীরা লাভ-লোভ এবং ক্ষমতার ভাগ চায়না। জাসদ কর্মীরা চায় জনগনের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করতে । ( সমাপ্ত)
লেখক –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।