করোনা কালের জীবন ধারা

     (পূর্ব প্রকাশের পর) (১৭) 

আমাদের মুসলিম পরিবারে কোন স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেই মৃতদেহ যত তাড়াতাড়ি সৎকার করার নিয়ম। এর মাঝেও মৃতব্যক্তিকে একনজর দেখার জন্য আপন-পর, পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব, হিতাকাঙ্খিগণ ছুটে আসে। এই দেখাকে বলে শেষ দেখা। মৃত্যুবরণ করার পর গোসলের জন্য বড়ই পাতা পানির মধ্যে দিয়ে পানি গরম করার পর লাশকে কাপড়ের পর্দার মধ্যে রেখে সাবান দিয়ে উত্তম রূপে গোসল দেওয়া হয়। গোসল শেষে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সাদা কাপড়ের কাফন পরানো হয়। মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে তিনটি কাপড় যেমন ইযার, কোর্তা আর চাদর, আর নারী হলে ইযার, কোর্তা, চাদর, ছেরবন্দ আর সীনাবন্দ কাপড় দ্বারা কাফন পরানো হয়।
কাফন পরানোর পর চোখে সুরমা ও গায়ে আতর এবং গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। জমজম কুপের পানি সংগৃহিত থাকলে তাও মুরদার শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। মরদেহটি খাটিয়ায় করে একটি নিরাপদ জায়গায় রাখা হয় আগতদের শেষ দেখা দেখার জন্য। খাটিয়ার চারকোনায় ও আশেপাশে লোবান বা ধুপকাঠি জ¦ালিয়ে রাখা হয়। মৃতদেহটি বনেদি হলে তাকে মশারির মধ্যে রাখা হয়। একটি শোক সংবাদ, ওমুক গ্রামের ওমুক ……. ইন্তকাল করেছেন। মরহুমের/মরহুমার নামাজে জানাজ …… ইত্যাদি ইত্যাদি নিজ গ্রাম/মহল্লার মসজিদে ঘনঘন প্রচার সহ মাইক যোগে তা বিভিন্ন এলাকায় ঘুর ঘুরে প্রচার করা হয়। মাইক যোগে প্রচারের সময় প্রচারকারির এমন তাড়া! থাকে যে, মাইকের সকল কথা শ্রোতাগণ সম্পুর্ণ বুঝতে পারেনা। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তির নাম ও জানাজা নামাজের সময় কিছুই জানা যায়না। এটা আমাদের সমাজের রীতি বলতে হয়।
যাক, এদিকে বাসা-বাড়ির এক কোনে পারিবারিক গোরস্থানে অথবা পাশের গোরস্থানে তার জন্য কবর খনন করা হয়। কোন কোন জায়গায় ‘‘বোগলী কবর’’ আবার কোন কোন জায়গায়‘‘ সিন্দুকি কবর’’ খনন করা হয়। এখনো গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গোর বা কবর খননের লোক পাওয়া যায়। কবরের উপরে দেওয়ার জন্য বাঁশের খাবাজি ও চরাট আত্মীয় স্বজনরাই প্রস্তুত করে থাকে।
মৃত ব্যক্তির বাড়ির আঙিনায়, পাশের ঈদগাহ ময়দানে অথবা পাশর্^বর্তী স্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মৃত ব্যক্তির সামাজিক পরিচয় ও গুরুত্ব অনুসারে তার মৃতদেহকে তার কর্মস্থল বা প্রতিষ্ঠানে শেষ ভ্রমণ করিয়ে আনা হয়। জানাজায় প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তি যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় দাফনের অধিকারি হয়ে থকেন তাহলে জাতীয় পতাকা দ্বারা দেহটি আচ্ছাদিত করা হয়। পুলিশের একটি চৌকসদল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মৃতদেহকে সামনে রেখে চলে বক্তৃতার পালা। এ বক্তৃতার যেন শেষ নেই। জানাজা নামাজের জন্য কাতার বন্দি মুসুল্লিরা অনেক সময় অধৈর্য হয়ে উসখুস করলেও বক্তাগণের বক্তৃতা কিছুতেই থামেনা। বর্তমানে করোনাকালে এমন ব্যক্তি মারা গেলে জানাজা নামাজে লোক সমাগম না করার জন্য রাষ্ট্রিয়ভাবে নিষেধ করা আছে।
তারপরও লকডাউন উপেক্ষা করার মত সেসব কথা উপেক্ষা করে জানাজা নামাজ আদায় করা হয়। এমন ঘটনার অবতারনা হয়েছিলো বাহ্মনবাড়িয়ার সরাইলে। প্রখ্যাত ইসলামি আলোচক মওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারি সাহেবের জানাজা নামাজে এই কঠিন করোনাকালে করোনার লকডাউন উপেক্ষা করে লাখো লাখো মানুষ জানাজায় শরীক হয়েছিলেন। যাক এরপর মৃত দেহকে সজতনে কবরের মাঝে দাফন করা হয়। দাফন শেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে তার জন্য দোয়া করা হয়।
খিস্টান ধর্মাবলম্বীর মরদেহ কফিনে ভরে কবরে দাফন করা হয়। কফিন দড়িতে ঝুলিয়ে কবরে নামানো হয়। খ্রিস্টানদের জন্য পৃথক কবরস্থান ‘‘ গ্রেইভইয়ার্ড’’ বা কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত শ্মশানে তাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মৃতদেহ দাহ্য করার জন্যও পৃথক শ্মশান রয়েছে।
বিশ^ব্যাপি করোনাকালে জেরুজালেমে কাফনের কাপড়ের বদলে প্লাষ্টিকে লাশ দাফন করা হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের লাশ সেখানে প্লাষ্টিকের ব্যাগে পুরে দাফন করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এ আমিরাকায় মৃতদেহের পরিমাণ এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লাশ দাফনের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। ঠিকাদারেরা একই কবরে একাধিক লাশ দাফন করছে বলে জানা গেছে।
আমাদের দেশে এপর্যন্ত (এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত) ৩শ ৮৬ জন করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজার ৭ শ ৩৮ জন । এপর্যন্ত সুস্থ্য হয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ২ শ ৭ জন। করোনায় মৃত্যুবরণকারি যে কোথায় হারিয়ে যায় কেউই তা আর জানতে পারেনা। করোনায় মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফন সহজে কেউ করতে চায়না। এমন ভুরি ভুরি ঘটনার অবতারনা হয়েছে।
মেহেরপুরে করোনা লাশ দাফন করতে গিয়ে দাফন কমিটিই পালিয়ে য়ায়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, মেহেরপুর জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ক্ষেত্রে মুজিবনগরের জন্য আলেমদের নিয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির ৫ সদস্য করোনা আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করার কথা। কিন্তু মুজিবনগরের ভবেরপাড়ায় করোনা উপসর্গে (সন্দেহ) নিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। এক কথায় তারা লাশ দাফন না করে পালিয়ে যায়। পরে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উদ্যোগে লাশটি দাফন করা হয়।
এনিয়ে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওসমান গণি তার ফেসবুক ওয়ালে একটি হৃদয়ছোঁয়া স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনি লিখেছেন, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছি,‘‘ ৫জন আলেমই অপারগতা প্রকাশ করে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ায় আমরা খুব বিপদে পড়ে যাই এবং অত্যন্ত নিরূপায় হয়ে পড়ি। তখন ডিসি স্যারের সাথে আলোচনাক্রমে আমি, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনজন একসাথে লাশ দাফনের জন্য যাত্রা করি। হুজুরদের জন্য আনা পিপিই স্থানীয় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের মধ্য থেকে চার যুবককে পরানো হয়। জানাজা পড়ানোর জন্য আমরা নিজেরাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ মুহুর্তে মওলানা তৌহিদুল ইসলাম ( গোপালনগর জামে মসজিদ) এসে জানাজায় ইমামতি করেন। অনেক ধন্যবাদ হুজুরকে। অতঃপর আমরা তিনজন কর্মকর্তা ও পাঁচজন যুবক মিলে লাশ দাফন করলাম। তিনি লিখেছেন, শুধু একটি বিষয় অজানা রইলো , পাঁচজন আলেম আমাদেরকে কি শিক্ষা দিয়ে গেলেন।’’
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের এক যুবক করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওার পর তার মরদেহ রখে পালিয়ে যায় স্বজনেরা। গত ১৯ এপ্রিল-২০২০, মেহেন্দিগঞ্জের লালকুঞ্জ এলাকায় পশ্চিম সুলতানির আব্দুল সর্দারের ছেলে নিজাম (৩২) করোনার উপসর্গ নিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা যান। এর পরেই তার স্বজনরা নিজামের মৃতদেহ রেখে পালিয়ে যায়। জানা যায়, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কতোয়ালী মডেল তানার কর্মকর্তারা নিজামের মৃতদেহ পরদিন সকালে জানাজা শেষে নগরীর রূপাতলীস্থ মুসলিম গোরস্থান-৩ এ দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো: শাহবুদ্দিন খানের নির্দেশনায় ও কোতয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলামের তত্বাবধানে এসআই আরাফাত হাসান ও মিজানুর রহমান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে দাফনকাজ সম্পাদন করেন। গত ১৭ মে, করোনাভাইরাসে মৃত্য হয়েছে সন্দেহেঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে পড়ে থাকা লাশটির কাছে যায়নি কেউ। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন এক পুলিশ সদস্য। শুধু তাই নয় নিজেই মরদেহ ভ্যান গাড়িতে তুলে সেটি চালিয়ে থানায় নিয়ে যান তিনি। ( চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।