করোনা কালের জীবন ধারা

   -
     (পূর্ব প্রকাশের পর) (১৩) 
          বিশ^ব্যাপি করোনভাইরাস বা কোভিড-১৯ মানুষের জীবন ধারাকে সম্পুর্ণরূপে ওলোটপালট করে দিয়েছে। বিশেষ করে সকল মানুষের স্বস্ব ধর্ম বিশ^াসের কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে  মানুষজন যে স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করবে তার ওপরও ভাগ বসিয়েছে করোনা। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাসহ সকল উপসনালয় লকডাউনের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা আছে। কোন কোন উপসনালয় সীমিত আকারে খোলা হয়েছে। যেমন আমাদের বাংলাদেশের সকল মসজিদ কতিপয় শর্তসাপেক্ষে খুলে দেওয়া হয়েছে। আগে যেমন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ বয়স্ক মুসুল্লিগণ এক ওয়াক্তের নামাজ আদায় পুর্বক পরবর্তী ওয়াক্তের নামাজ আদায় পর্যন্ত কিন্বা যখন তখন মসজিদে গিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ ওজিফা পাঠ করতে পারতেন এখন করোনার কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছেনা। কারণ করোনাকালে তাদের জন্য আপাতত আর সেসুযোগ নেই। এদেশের বেশিরভাগ মসজিদই চলে মুসল্লিদের দানের ওপর। মসজিদে ১০/১২ জন ছাড়া মুসুল্লি নেই তো দানও নেই। । অনেক মসজিদে ইমামের বেতন বাকি। মোয়াজ্জিনের বেতনতো পরের কথা। ফলে ইমামকে অনেক ক্ষত্রে মোয়াজ্জিন দুটো ভুমিকাই পালন করতে হচ্ছে। 

এখন চলছে পবিত্র রমজান মাস। এই পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের কাছে ভীষণ খুশির মাস। রাতের শেষ প্রহরে সেহেরি খাওয়া, সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পুর্বে ইফতার পর্ব সমাধা করা এবং এরপর কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে এশ‘া ও তারাবি নামাজ আদায় করা। মসিজদের মুসুল্লি ভেদে দুধরণের তারাবি নামাজ আদায় করা হয়, সুরা তারাবি এবং খতম তারাবি। এবারে এই তারাবি নামাজ আদায়ের উপরও শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। কারণ লকডাউন পালনের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনেই সকল মসজিদে তারাবি নামাজসহ সকল নামাজ আদায় করতে হচ্ছে। আইন মোতাবেক ওয়াক্তিয়া নামাজে ৫, জুম‘ার নামাজে ১০ আর তারাবি নামাজে ১২জন মুসুল্লি।
পবিত্র রমজান মাস জুড়েই মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় আমেজে সকল সময় ভরপুর থাকে। এই আমেজের একটি অংশ হলো ইফতার মাহফিল। বলতে গেলে এটা বাংলাদেশের মুসলামনদের একটি রেওয়াজ।, মসজিদ-মাদরাসা, এতিমখানা, মাজার শরীফ, খানকা শরীফ, নিজ বাসা-বাড়িতে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন প্রেসক্লাব, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ি মহল, বিভিন্ন সমিতি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্তরেই ইফতার মাহফিলের আয়োজন চলে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইফতার মাহফিলের কদর তুলনামুলকভাবে একটু বেশি। কারণ এর মাঝে নেতা-নেত্রী এবং দলীয় কর্মিদের সম্মিলন ঘটে থাকে। সামনে যদি কোন নির্বাচন বা উপ-নির্বাচন থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। ইফতার মাহফিলের নামে ভুরিভোজের আয়োজন করে নিজের পক্ষে ভোটারদেরকে টানা এ এক মোক্ষম হাতিয়ার বটে। তবে দুর্মুখেরা বলে আজকাল আর ভোটের জন্য ভোটারদের কাছে বেশি ধর্ণা দিতে হয়না। ভোটের আগের দিন সন্ধ্যা বেলা নাকি ইভেনিং ভোট, রাতের বেলা নাইট ভোট আর সকাল বেলা মর্ণিং ভোটের কারণেই ভোটের বাক্স ভরে থাকে। এমনি এমনি নাকি ভোট হয়ে যায়।
সে যাই হোক এবারে করোনাকালের জীবনধারায় মুসলমানদের জন্য সকলপ্রকার মাহফিলসহ ইফতার মাহফিলও বাতিল। তবে ইফতার মাহফিলের টাকাটা যদি করোনা কালের গরীব-দুখিদের কল্যাণে ব্যয় করা হতো তাহলে তারা বেশ উপকৃত হতো। এদেশের ধনী মুসলমানেরা তাদের মালের জাকাত এই রমজান মাসেই গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এছাড়া এই পবিত্র রমজান মাসে প্রতিটি স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্যই সাদাকাতুল ফিতরা বা ফিতরা প্রদান ওয়াজিব। গরীব-দুখিরা এর মাধ্যমেও উপকৃত হবেন। পবিত্র রমজান মাসে সাদাকাতুল ফিতর ও নেছাব পরিমান মালের জাকাত সরাসরি গরীবের হাতে পৌঁছে। এতে চোর ছ্যাঁচোড় নেতা, যারা ত্রাণ চুরির অপরাধে অপরাধি তাদের মত কোন ব্যক্তিই ভাগ বসাতে পারেনা।
এই পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০দিন মুসলমানদের জন্য উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। এসময়কে বলা হয় নাজাতের অধ্যায়। এই ১০ দিনের যে কোন রাতে মহামান্বিত একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। তা হলো লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত। এই রাতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ওপর হজরত জিবরাইল আমিনের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন শরীফ নাজিল করেন। তাই এই মহামান্বিত রাতকে তালাশ করার জন্য রমজান মাসের শেষ ১০দিন এ‘তেকাফ পালনের রীতি রয়েছে। মুসুল্লিগণ এসময় খাছ এবাদতের জন্য এ‘তেকাফ পালনের উদ্দেশ্যে নিজ ঘর-বাড়ি ছেড়ে মসজিদে সারাক্ষণ অবস্থান করেন। এবার করোনাকালে সারাক্ষণ মসজিদে অবস্থান সম্পুর্ণভাবে নিষেধ করা আছে। করোনাভাইরাসের মধ্যে তাদের এবারের বন্দেগি কেমন হবে তা কেবল আল্লা রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন।
করোনা যুদ্ধকালিন ঈদের নামাজের কথা একটু বলতেই হয়। লকডাউনের মাঝে ঈদের নামাজ আদায় করতে ঈদগাহ ময়দানেতো যেতেই হবে। এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রনালয় থেকে পৃথক কোন বার্তা না জাননো হলেও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ঈদ পালিত হয়েছিলো। তা হলো রোজার ঈদ। সেসময় আমি (এই প্রতিবেদক) একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য ছিলাম। আমাদের মুক্তি বাহিনীটি তখন শাহজাদপুর থানার বিলাঞ্চল রাউতারা পাঁথারের মধ্যে গয়নার নৌকাতে অবস্থান করছিলো। এই দলের কমান্ডার ছিলেন পোতাজিয়ার আব্দুল মতিন মোহন মিয়া।( পরবর্তীকালে পোতাজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, বর্তমানে মৃত।) আমি ছিলাম সেকেন্ড ইন কমান্ড বা টু আইসি। আগামি কয়েকদিনের মধ্যে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। তখন বর্ষাকাল। চারদিকে অথৈ পানি। শুধুমাত্র পোতাজিয়া গ্রামের গোরস্থান এবং তারই পাশের ঈদগাহ মাঠ কোনমতে শুকনো।
প্রতি বারের ন্যায় এবারো সেখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। নামাজে যেতে হবে নৌকাতে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। বর্তমানে কোরনা যুদ্ধের ভয়ে মসজিদের ঈমাম সাহেবদের ঘরে থাকার পরামর্শ । তখনকার যুদ্ধের সময় ইমাম পাওয়া ছিলো দুষ্কর। একথা বল্লে অত্যুক্তি হবেনা যে, সেসময় এক শ্রেণির ওয়ায়েজিন, মোদার্রেস, মৌলবী, তালবেএলেম ও ইমাম সাহেব পিস কমিটির সদস্য, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর খাতায় নাম লিখিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলিয়ে বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিলো। তাই মুক্তি বাহিনী ভীতি ছিলো তাদের মধ্যে প্রবল। যারা দাগি-দোষি আলেম- ওলামা তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অতি প্রিয়ভাজন হলেও মুক্তিবাহিনী ছিলো তাদের যম। সামনে পেলেই আর তাদের রক্ষা ছিলোনা। ওক্ ক‘রে ধরে তাদের কল্লা দুভাগ করে দিতো। অথবা গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিতো। তাই সেসময় তারা বেশিরভাগই নিজ বাড়িতে না থেকে ঝোপে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াতো।
যেসকল আলেম উলামা পুত পবিত্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যাদের অবস্থান তারা আবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ভয়ে ভীত ছিলো। এমনি অবস্থার মধ্যে ঈদের মাঠে নামাজ পড়ানোর ইমাম পাওয়া যাচ্ছিলোনা। এক ইমাম সাহেবকে সকল দিক থেকে অভয় দিয়ে ঈদগাহে নামাজে ইমামতির জন্য রাজি করানো হলো। ঈদের দিন সকাল হতেই পোতাজিয়া ঈদগাহ ময়দানের চারপাশে মুক্তিবাহিনীর পাহারা বসিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়েছিলো। ভাগ্য ভালো বলতে হবে পরবর্তীতে ঈদুল আজহা নামাজের যখন সময় হলো তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
এবারও যেন সেরকমই হয়। অর্থাৎ করোনা যুদ্ধের সময় ঈদুল ফিতরের নামাজ এবং করোনা থেকে মুক্তি পাবার পর যেন স্বাধীনভাবে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করা যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের সেই মনোবাসনা পুরণ করেন। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।