শিশির ভেজা শুভ্র সকালে ছোট ছোট দুর্বাঘাসে খালি পায়ে হেঁটে চলার এক ধরনের শিহরণ তৈরী হয়। বহুদিন পর মনে হলো এ অনুভূতি আমাকে আগের মতো বিহ্বল করে কি না। তাইত সকাল হতে বিছানার মায়া কাটিয়ে আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীর তীর ধরে আলতো পায়ে হেঁটে চলা শুরু করলাম।কালের বিবর্তনে ছোঁয়া লেগেছে আমার চিরচেনা এ নদীটিতে। দুপাশ অনেকটা দখল হয়ে গেছে। নদী সাথে যে ছোট ছোট খাল ছিল তাও আজ বিলিন হয়ে গেছে।নদী থেকে এ খাল দিয়ে আগে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ফসিল জমিতে সেচ দিত।একসময় নাকি এ নদীতে কুমিরের বিচরণ ছিল। আমাদের কাছে তা কল্পকথার মতো মনে হয়। তেমনি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে যদি বলি এ নদীর দুই তীরে ছোট ছোট অনেক খাল ছিল। তারা হয়ত বলবে তুমি নদী পেলে কোথায়। এটিই ত একটি ছোট খাল। এতে হয়ত আমি আবাক হলেও ওরা বোকা বনে যাবে আমার অবাক হওয়া দেখে! আমরা আমাদের জীবন জীবিকার তাগিদে নিরন্তর ছুটে চলি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। গ্রামের যে মেঠো পথটি ধরে একসময় দুরন্ত বালকের মতো ছুটে বেড়িয়েছি আজ আর সে দিন নেই। খুব ইচ্ছে করে আবার সেই দিনে ফিরে যেতে। যেমনি ভাবে জোসনা রাতে সারারাত ধরে যে গাছগাছালির ছায়ায় সবুজ প্রান্তরে ঘাসের চাদরে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অবগাহন করেছেন। সোনালি দিনের সেই জায়গায় আজ শুধুই ইট পাথরের স্তুপ। নির্মল বাতাস আর চাঁদের আলো বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে আর পূর্ণিমার চাঁদ দেখা মেলা ভার। তবুও নিজের অজান্তে কখন পিচঢালা পথ ছেড়ে আমার চিরচেনা সেই নদীর তীর ধরে আলতো পায়ে হেঁটে চলছি আমি নিজেও বুঝিনি। হঠাতই একটগ থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম এইত আমার কৈশোরের সেই দুর্বাঘাস। যেখানে বন্ধুরা সবাই মিলে ভরদুপুরে তাস খেলেছি। প্রখর রোদের চাইতে খেলার নেশা অনেক অনেক বেশি ছিল। মনে পরে ছেলেবেলার দস্যিপনার কথা। নদীতে বিলে খালে মাছ ধরার কথা। মনে পরে ক্ষেতের কিনারায় ডোবা থেকে মাছ ধরার কথা। সেথায় মোদের কাদামাটিতে মাখামাখির কথা। মাছ পেলে ভালো, না পেলে আরো ভালো। কারণ মাছ ভাগাভাগির কোন চিন্তা নেই।
নদীর পাশের খালগুলির কথা মনে পড়ে বড্ড বেশী। কেন পড়বেনা আমাদের ধানি জমি যেমন ছিল। তেমনি তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খাল। আমার মেজো চাচা আমাদের সমস্ত জমির দায়িত্ব ছিল তার উপর। আমাদের একান্নবর্তি পরিবার। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন মিলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩ জন। আমার মেজো চাচা অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমায় আজো করেন। বর্ষার শুরুতে এবং শেষে একটি কাজে ফাঁক পেলেই আমি চাচার পিছ ধরতাম। গ্রামের বাড়িতে শাকসবজির কোন অভাব নেই। তাই চাচা মাঝে মধ্যে জালি আর ডুলা (এক ধরনের মাছ রাখার খাচি) নিয়ে বেরিয়ে পরতেন মাছ ধরতে। পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে আমাকে সাথে নিতে চাইত না। স্কুল বন্ধ থাকলে আমাকে সাথে না নেয়ার কোন উপায় ছিল না। বড় খাল অথবা ছোট খালে মাছ ধরার আনন্দ যেমন ছিল ভয়ও ছিল তেমন। আনন্দ লাগত প্রচুর মাছ ধরা যেত বলে। আর ভয় থাকত জালি দিয়ে খেও দিতে যেয়ে একটু পরপর মাছের সাথে সাপ উঠত বলে। সাপ উঠলেই জালি শুকনো জায়গায় খালের ধারে রেখে দুরে বসে থাকতাম চাচা ভাতিজা। একসময় সাপ চলে যেত সাথে দু একটি মাছও। এ দুটি খালে প্রচুর কৈ, টেংরা, পুটি, টাকি, চিংড়ি, ভেরা, বজরি, খলশা মাছ পাওয়া যেত। এ সব মাছের প্রতি আমার লোভ ছিল। মাঝে মাঝে শোল,মিরকা কখনো কখনো বোয়াল মাছ পাওয়া যেত। বড় মাছ পেলে চাচা আরো বেশি সময় নিয়ে জালি খেওয়াত। অনেক সময় বেলা পড়ে যেত। এভাবে মাছ ধরলে আমাদের পরিবারের দু তিনদিনের মাছের ব্যাবস্থা হয়ে যেত। আজও চাচাকে বড্ড বলতে ইচ্ছে করে চাচা আবার চলো মাছ ধরি! মাছ যে ধরব সেই ছোট আর বড় খাল আজ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
খালগুলি আজ বিলিন হয়ে গেছে তাতে যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তার চাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছি নদীর দিকে তাকিয়ে। যে নদীর পানি ছিল টলটলে জলের মধ্যে মাছ দেখা যেত। রাতের আধারে কোছ দিয়ে মাছ ধরা যেত। সে নদীর জল আজ একি রূপ। এই নদীতে বর্ষাকালে দু-পারের মানুষ দুপুর বেলা কিম্বা পরন্তু বেলায় মনের আনন্দে গোসল করতে নেমে পড়ত। সবাই মিলে স্নান করতে করতে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা মশগুল হয়ে যেত। আজ এ নদীর এ কি হাল। নদীর পানির দিকে তাকিয়ে আমি হত বিহবল। নদীর পানি ছিল টলটলে আর আজ নদীর পানি ঘোলাও না কারখানায় ময়লা রাসায়নিক পদার্থ নদীতে ফেলে পানি এক বিচ্ছিরি রূপ ধারণ করেছে। এ পানিতে নামলে নাকি গা চুলকায়।
আমার ছোট বেলার খেলার সাথী, দুরন্ত পথ চলার পথিক, নির্বিগ্নে অবগাহন করার সারথি। আজ কোথায় যেন বিচ্ছেদের সুর বাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
যে নদীর বুকে পালতোলা নৌকা করে একসময় পরম মমতায় মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুরে বেড়িয়েছি আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। আজো মনে পড়ে নদীর ঢেউ এ আমাদের ছোট তরীতে দোলনার মতো দোলার কথা। নদীর নির্মল বাতাস কখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছে বলতে পারিনি। মা বারবার জাগিয়ে দিত নদীর ঢেউ দেখতে। মাঝি তাঁর নৌকা সবসময় নদী বা বিলের কিনার দিয়ে নৌকা বাইত। আর আমরা নৌকায় বসে দেখতাম জেলার মাছ ধরত আর দুরন্ত ছেলেরা মনের আনন্দে সাঁতার কাটত। গায়ের বঁধুরা ঘোমটা দিয়ে বিলের কিনারায় তালগাছ দিয়ে তৈরী ঘাটে কাপড়-চোপর ও হাড়ি-পাতিল পরিস্কার করত। তারপর স্নান টান সেরে একবারে বাড়িতে ফিরে যেত।
আজ সেই গয়নার নৌকাও খুব একটা দেখা যায় না। আর নদীর দু কুলের বিলের মধ্যে কচুরিপানা আর লতাপাতায় এমনভাবে ভরে থাকে ঠিকমতো পানিও দেখা যায় না।
অনেক অনুভূতি নিয়ে সকালের শিশির বিন্দুতে পা রাখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার অনুভূতি গুলো আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। মনে হচ্ছে কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই চিরচেনা নদী, কোথায় হারিয়ে গেছে আমার সেই চিরচেনা মেঠো পথ আর জোৎসার আলোমাখা পূর্ণিমার রাত। আমার নদীটি যে নর্দমা বানিয়েছে আমার শৈশবের স্মৃতিমাখা খালগুলি যে দখল করেছে। সে কি আমার দেশের মানুষ না। সে কি এক আলো সাতাসে মানুষ হয়নি। হায়নার মতো সর্বোগ্রাসী খুদা আমাদের আজ কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সন্তান কি এ দেশের মাটি পানি বায়ু সেবন করে বেড়ে উঠছেনা। যে মাটির বুকে দাড়িয়ে আছি তার ধুলি কনায় মাখামাখি করে আমরা আজও বেঁচে আছি। তাইত এ বাংলা মায়ের কাদামাটি মেখে আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে পারি ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।
লেখক: মোহাম্মদ কানিছুর রহমান
উপ-রেজিস্ট্রার
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
টাঙ্গাইল।