মহানবী হজরত মোহাম্মদ্ (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য মক্কাবাসিকে আহŸান জানানোর পর মক্কার কুরাইশ ও মুশরিক স¤প্রদায় তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন ও অত্যাচার চালাতে থাকে। হজরতের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়লে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইশারায় তিনি পবিত্র মক্কা ভূমি পরিত্যাগ করে মদীনাতে হিজরত করেন। কিন্তু কাফির ও মুশরিকগণ কিছুতেই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর মক্কার কুরাইশ মুশরিকগণ বেশ কয়েকবার মদীনার উপকন্ঠে এসে লুট-তরাজ করে ফিরে যায়। তাদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ নামক জনৈক মুহাজিরের নেতৃত্বাধীনে একটি গোয়েন্দা দল গঠন করে মক্কা সিমান্তে পাঠিয়ে দেন। তাদেরকে এই উপদেশ দেয়া হলো যে, তারা সেখানে অবস্থান করে মুশরিক কুরাইশদের গতিবিধি ও সমরায়োজন সম্বন্ধে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসবে। এই দলের আটজন সদস্য মক্কার নিকটবর্তী ‘‘ নাখলা ” নামক স্থানে উপনীত হলে তাদের সঙ্গে হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র কুরাইশ কাফেলার মোকাবিলা হয়ে যায় এবং অনাকাঙ্খিতভাবে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। কাফিররা সংখ্যায় ছিলো মাত্র চারজন। এদের মধ্যে একজন নিহত ও দুজন বন্দি হয় এবং বাকি একজন পালিয়ে গিয়ে কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ানকে খবর দেয়।
এই সংবাদে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং তারা পুর্নোদ্দোমে যোদ্ধা, হাতিয়ার ও রসদপত্র সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র ক্রয় করে আনার জন্য পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা এবং এক হাজার উট নিয়ে আবু সুফিয়ান সিরিয়া যাত্রা করে।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর চাচা আব্বাস (রা.) লোক চক্ষুর অগোচরে ইসলাম গ্রহণ পুর্বক নিজ ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত মহানবী (সা.)কে সাহায্যের জন্য তিনি আবু সুফিয়ানের গতিবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লোক মারফত গোপনে খবর পাঠান।
যুদ্ধ আসন্ন দেখে হজরত মোহাম্মদ (সা.) মদীনা বাসিদেরকে অস্ত্র ধারণ করতে আহŸান জানান। ইতোপূর্বে যে সনদপত্র সাক্ষরিত হয়েছিলো তাতে শর্ত ছিলো যে, বহি:শত্রু দ্বারা যদি মদীনা আক্রান্ত হয় তবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে মিলে তা প্রতিহত করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে তেমন আগ্রহ লক্ষ করা গেলনা। বরং তাদের ভাব-ভঙ্গি ও আচার আচরণে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কুরাইশগণ মদীনা আক্রমণ করে নব জাগ্রত মুসলিম শক্তিকে ধ্বংস করে দিলেই তারা খুশি।
একথা নবী করিম (সা.) উপলব্ধি করেও চুপ করে রইলেন। তিনি মুহাজির সাহাবি এবং আনসার সাহাবিসহ সকলকে নিয়ে এক পরামর্শ সভা আহŸান করলেন। সমর পরিস্থিতিরি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বদর গিরিপথকে নিজেদের দখলে রাখার বিষয় অবহিত করলেন। কারণ বদর ছিলো মক্কা, মদীনা ও সিরিয়ার রাজপথেরে সন্ধিস্থল এবং মদীনার এলাকাধীন। আবু সুফিয়ান সিরিয়া হতে রণসম্ভার নিয়ে ফিরবার পথে তাকে সেখানেই বাধা প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে সকলেই একমত পোষন করলেন। নবী করিম (সা.) মাত্র ৩১৩ জন দুঃসাহসিক মুসলিম বীরকে সঙ্গে নিয়ে বদর প্রান্তরে রওনা হলেন। মুসলমানদের অস্ত্রশস্ত্র ছিলো নিতান্তই মামুলি। অশ্বারোহি ছিলেন মাত্র ২জন এবং যানবাহনের জন্য উট পাওয়া গেল মাত্র ৭০টি। এই যুদ্ধযাত্রায় ৭০জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। তারা কাফিরদেরকে ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চাননি। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা অনির্ধারিত সময়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ও শত্রæদের মাঝে মুখোমুখি দাঁড় করালেন।
এদিকে সুচতুর আবু সুফিয়ান সিরিয়া হতে সমরাস্ত্র নিয়ে ফিরবার পথে বদর উপত্যকার নিকটে এসে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। আগে থেকেই তার সন্দেহ ছিলো যে, মদীনাবাসি বদর গিরিপথে এসে তাকে বাধা দিতে পারে। সে অতি সন্তর্পণে পথ চলতে গিয়ে কয়েকটি উটের পায়ের দাগ দেখতে পায় এবং কিছু দুর গিয়ে উটের কিছুটা শুষ্ক বিষ্ঠা পানিতে ধুয়ে দেখে তার ভিতর যে খেজুরের আঁটি পাওয়া গেল তার আকৃতি মক্কার খেজুরের আকৃতির চেয়ে ছোট। এতে তার সন্দেহ আরো ঘনিভুত হলো যে, মদীনার লোকজন এই অঞ্চলে ঘোরা ঘুরি করছে। তাই সে ভিন্ন পথে রওনা হয় এবং তাকে আক্রমণ করা হতে পারে মর্মে বিশেষ বাহক মারফত মক্কার কুরাইশদের কাছে খবর পাঠায়।
কুরাইশ স¤প্রদায়ের নিকট খবর পৌঁছা মাত্রই তারা সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১হাজার। তন্মধ্যে ১০০জন অশ্বারোহি ৭০০ জন উষ্ট্রারোহি ও অন্যান্যরা পদব্রজি সৈন্য ছিলো। অতঃপর আবু সুফিয়ান যখন কুরাইশদের যাত্রার কথা জানতে পারলো তখন সে নিজের নিরাপদে ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে যুদ্ধ ছাড়াই কুরাইশদেরকে মক্কায় ফিরে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধ ছাড়া পিছু ফিরে যেতে অস্বীকার করলো। আবু জেহেল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বল্লো, আমরা যখন এত কষ্ট করে বদর উপত্যকার কাছাকছি পৌঁছে গেছি তখন মদীনাবাসিদেরকে শায়েস্তা না করে কিছুতেই ফিরে যাবোনা। আমরা বদর প্রান্তরে তিনদিন অবস্থান করবো, তথায় উটের গোস্ত খাবো, মদ পান করবো, আমাদের সাথে নর্তকি আছে তাদের নাচ দেখবো এবং যারপর নাই আনন্দ স্ফুর্তি করবো।
মদীনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত বদর নামক উপত্যকায় ১৩ মার্চ-৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ আরবি দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শুক্রবার, হজরত বেলাল (রা)এর কন্ঠে ফজরের আজান ধ্বনিত হলো। মুসলমান যোদ্ধাগণ কাতারবন্দি হয়ে নবী করিম (সা.) এর ইমামতিতে নামাজ আদায় করলেন। নামাজান্তে হজরত যুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। এরপর বদর প্রন্তরে তাঁর জন্য নির্মিত ছোট্র ঝুপড়ি হুজরা শরিফে প্রবেশ করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট দু’হাত তুলে দু’আ জানালেন, -“ হে আললাহ আজ যদি তুমি এই ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীকে ধবংস করে দাও তাহলে জমিনের বুকে তোমার বন্দেগি করার মত আর একজনও থাকবেনা।” তারপর দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং হাস্যোজ্জল চেহারায় মুসলিম বাহিনী সাহাবীদের নিকট এসে ঘোষণা দিলেন,“ শোন, কাফিরদের পরাজয় অনিবার্য এবং তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে।” পবিত্র কালামে ইরশাদ হয়েছেঃ অচিরেই শত্রæ বাহিনী পরাস্ত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে।” (সুরা ক্বামার-৪৫)।
বদর যুদ্ধের প্রক্কালে রাসুল (সা.) আরো দু’আ করেছেন যে, “ হে আল্লাহ এরা (সওয়ারির অভাবে) পদব্রজেই রওয়ানা হয়েছে, তুমি এদের সওয়ারি দাও। হে পরওয়ারদেগার এরা ক্ষুধার্ত এদের অন্ন দাও। এরা বস্ত্রহীন, এদের বস্ত্র দাও।” (খাসায়েসুল কুবরা)। আল্লাহর অপার মহিমা, সত্যিই মুসলমানগণ বদর থেকে বিজয়ী বেশে ফিরার পথে প্রত্যেকে একটি কি দুটি করে উট নিয়ে ফেরেন। তাঁরা পোষাক পরিধান করেন এবং পেট পুরে আহারও করেন।
বদর যুদ্ধে মুসলমানগণ যদিও সংখ্যালঘু ছিলেন কিন্তু প্রথমত তাঁরা জানতেন না যে, তাঁরা শত্রæ পক্ষের তুলনায় খুবই নগন্য। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, বদর যুদ্ধে শত্রæপক্ষের সৈন্য সংখ্যা আমাদের দৃষ্টিতে একেবারেই কম প্রতিয়মান হচ্ছিল ফলে আমি আমার পার্শ্বে দন্ডায়মান আমাদের জনৈক সৈনিককে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তাদেরকে কয়জন দেখছো? সত্তুর জন না আরো বেশি? সে বলল, আমার মনে হয় একশ জন। তিনি বলেন, পরে আমরা যখন একজন সৈন্যকে গ্রেফতার করলাম তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তোমাদের সংখ্যা কত? সে উত্তর করলো এক হাজার (ইবনে সাদ)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে আছে যে, বদর প্রান্তরে আল্লাহ তাঁর হাবিব ও মুসলমানদিগকে এক হাজার ফেরেশ্তা দিয়ে সাহায্য করেন। একদিকে অবস্থানকারি পাঁচশ ফেরেশতা বাহিনীর প্রধান ছিলেন জিব্রাঈল (আ.), অপরদিকে অবস্থানকারি পাঁচশ এর প্রধান ছিলেন মিকাঈল (আ.)।(আবু নয়ীম)।
বদর প্রান্তরে মহান আল্লাহ তায়ালার গায়েবী মদদ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীকে অবিস্বরণীয় বিজয়ের স্বাদ
আস্বাদন করান। মূলতঃ এই ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ছিলো হক ও বাতিলের যুদ্ধ অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।