পিঠমোড়া হ্যান্ডকাফ পড়ানো সাংবাদিক শফিকুল ইসলামঃ প্রাসঙ্গিক কথা

মে তিন শনিবার ছিলো বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস।আর দিবসটিতে দেশের সংবাদকর্মীদের একটি ছবি যেন চমকে দিয়েছে।এ দিন বেনাপোল পোর্ট পুলিশ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে যশোর আদালতে নিয়ে যায়। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেশবাসী ও দেখতে পেয়েছেন।এ ছবিটা দেখে আমি লজ্জিত,ক্ষুব্ধ ও ব্যাথিত হয়েছি।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ঢাকার দৈনিক পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক।তিনি এক প্রভাবশালী এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ করেন।তার বিরুদ্ধে কামরাঙ্গীর চর, হাজারীবাগ ও শেরে বাংলা নগরে আইসিটি আইনে মামলা হয়।
গত ১১ মার্চ ঢাকার হাতিরপুল অফিস থেকে তিনি নিখোঁজ হন।পরদিন তার স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌস নয়ন চকবাজার থানায় জিডি করেন।তার খোঁজের দাবিতে ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বেশ কয়েকবার সাংবাদিকরা মানববন্ধণ করেছেন।অবশেষে প্রায় ২ মাস পর শনিবার গভীররাতে বেনাপোল রঘুনাথপুর মাঠ থেকে বিজিবি তাকে আটক করে।বিজিবি ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা করে তাকে পোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।পরদিন রবিবার তাকে পুলিশ পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে তাকে যশোর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে তোলে।

আদালত এ মামলায় তার জামিন দিলে ও পুলিশ ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেফতারের আবেদন করে। আদালত তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার মঞ্জুর করে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম যদি প্রকৃত অর্থে কারও বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে তাতে কারও মানহানি হলে অবশ্যই তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আছে।আবার সাংবাদিক শফিকুল ইসলামের ও তার পক্ষে সংবাদের সত্যতা প্রমাণের সুয়োগ বা অধিকার আছে।সেটা আদালতই নির্ধারণ করবে। সে দোষি হলে শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু তার আগেই তাকে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে পুলিশের আদালতে নেয়ার যৌক্তিকতা কী থাকতে পারে।এটা কখনও কাম্য হতে পারে না।
এ ঘটনা দেখে প্রতিবাদের ভাষা ও যেন হারিয়ে ফেলেছি।এ ঘটনাটি আমার মনে এতই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে যে নিজেই যেন শফিকুল ইসলাম কাজল বলে মনে হয়েছে।লজ্জায় ক্ষোভে মন থেকেই যেন ধিক্কার বেড়িয়ে গেল।মনে হলে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে পুলিশ সাংবাদিক শফিকুল ইসলামকেই হেয় করে নি গোটা সাংবাদিক সমাজকেই হেয় করেছে।

এনিয়ে লিখতে বসে নিজেকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করছে। প্রথম প্রশ্নটিঃ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কী কুখ্যাত সন্ত্রাসী? দাগি খুনি? ত্রাণ চোর ? না ব্যাংকের টাকা লোপাটকারী ? আসলে ব্যাংকের টাকা লোপাটকারীরা তো মহা শক্তিধর।পুলিশ তাদের কি হাতকড়া দিয়ে আদালতে নেয়ার সাহস রাখে? না ধর্ষক? না জঙ্গী? নাকি শফিকুল ইসলাম মাদক বিক্রেতা? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কেন একজন সাংবাদিককে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আদালতে তোলা হলো? যশোর পুলিশের কর্তারা এর কী জবাব দেবেন ?

হয়তো জবাব দেবেন পুলিশকে আক্রমণ করে সে পালিয়ে গেলে সব দায় তাদেরই নিতে হতো। এ জন্য পিঠমোড়া করে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো হয়েছে। আর ও বলবেন পুলিশ তার আইন পালন করেছে মাত্র।তা হলে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাই সবার ক্ষেত্রে কি এ হাতকড়া পড়ানোর আইন আপনারা পালন করছেন? এর উত্তর আপনারা কি দিতে পারবেন? পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে ৫৪ ধারা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়।সব সরকার আমলেই ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে ১৬৭ ধারায় তদন্তের নামে আসামীদের রিমান্ডে এনে নির্যাতন করার ঘটনা অহরহ ঘটছে।এটা যেন দমন পীড়ণে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।কেউ এ ধারা বাতিল চায় না। বিএনপি ও এ ধারা বাতিলের ঘোরতর বিপক্ষে।গত ৪ দলীয় জোট আমলে তারা এ ধারা যথেচ্ছা প্রয়োগ করে কি না করেছে।

তার একটিমাত্র উদাহরণ পাঠকের মনে করিয়ে দিতে চাই। ময়মনসিংহ সিনেমা হলে বোমা হামলা হয়। সে মামলায় ৫৪ ধারায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন ও খ্যাতনামা লেখক শাহরিয়ার কবিরকে আটক করে। তারপর ১৬৭ ধারায় তদন্তের নামে রিমান্ডে এনে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায়। হাইকোর্ট ব্লাষ্ট ও কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এ নিয়ে সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে।

৯৮ সালের ২৯ নবেম্বও সরকারের উপর কেন এটা বাতিল হবে বলে কারণ দর্শানোর নোটিশ করে। কয়েকবার শুনানি হয়।২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারগতি সালমা মাসুদ ছৌধুরী ৬ মাসের মধ্যে এ বিধানটি সংশোধনের নির্দেশ দেন। আইনটি সংশোধন না করা পর্যন্ত ১২ টি নির্দেশনা দেন।৪ দলীয সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতে আপিল করেন। সে আবেদনে জানানো হয় এধারা সঠিক। বর্তমান আমলেও একই ধারা চলছে।
আসলে ক্ষমতায় থাকলে এ ধারা তখন দেশ শাসনের জন্য ভালো আর ক্ষমতায় না খাকলে তারা যখন এ আইনের ঘোরপাকে পড়ে নির্যাতিত হয় তখন বলে খারাপ।আবার ক্ষমতায় গিয়ে ভুলে যায়।এভাবেই চলছে ৫১ আর ১৬৭ ধারার ব্যবহার।

আজ বলতে দ্বিধা নেই পুলিশের অনেক নেতিবাচক ভাবমুর্তিকে পিছনে ফেলে করোনাকালিণ তাদের ভুমিকা যেন জাতীকে আশাবাদি করে তুলেছে। করোনা মোকাবেলায় রাস্তার সৈনিক হিসেবে তাদের মানবিকতা আমাকে ও মুগ্ধ করেছে। অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।তাদের আত্মদানকে স্যালুট জানাই।কিন্তু পাশাপাশি এও বলতে বাধ্য হচ্ছি যশোর পুলিশের এ ভুমিকা তাদের অর্জণকে কিছুটা হলে ও ম্লান করে দিয়েছে।শুধু তাই নয় সারা দেশের সাংবাদিক সমাজ এ ঘটনায় যেভাবে ফুঁসছে তাতে প্রতিপক্ষ যেন হয়ে উঠছে পুলিশ। এটা কাম্য হতে পারে না।তাই পুলিশ বিভাগ বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি অনুধাবণ করবে ততই যেন ভালো।

আর আজ একটি কথা বলতে হচ্ছে,সাংবাদিক শফিকুল ইসলামকে এ নাজেহালে সাংবাদিক সমাজ ও আজ প্রশ্নের সন্মুখিন। তার যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ আপনাদের কী মনে পড়ে ৪দলীয জোট আমলে জাতীয় প্রেসক্লাবে পুলিশী হামলার কথা? সেদিনের ভয়ঙ্কর সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সে সময় ও একশ্রেণির সুবিধাভোগি নেতাদের ভুমিকা যেমন সাংবাদিক সমাজকে হতাশ করেছে। আজ ও সাংবাদিক নেতাদের ভুমিকা সাংবাদিক সমাজকে আহত করছে।সব সময়ই যেন সাংবাদিক নেতারা হালুয়া রুটির ভাগ নিয়ে ব্যস্ত। যুগ যুগ ধরে এরকমই হয়ে আসছে।

লিখতে বসে আমার মনে হয়েছে,বর্তমান সরকারের কিছু অতি উৎসাহি নেতার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ সরকারের অনেক ভালো কাজ তথা উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছে।তাদের হয়ে যেন প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা এমন কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে যা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।তার সর্বশেষ প্রমাণ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের এ ঘটনা। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কি অপহরণের শিকার ? না কি সে স্বেচ্ছায় ভারতে পালিয়েছিলো? এটার রহস্যভেদ কিন্তু রাষ্টকেই করতে হবে।যতই বলা হোক সাংবাদিক ভারত থেকে আসার পথে আটক করা হয়েছে এটা সাধারণ মানুষ ও বিশ্বাস করবে না। আর সাংবাদিক সমাজের তো বিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। তাই রাষ্ট্রকেই প্রকৃত সত্য অনুসন্ধাণ করে দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।আর যদি অনৈতিকভাবে এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয় তা হবে কলঙ্কজনক বিষয়।আর হ্যা জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপি এদিনটি মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করলেও আমাদের মতো দেশে কোন কালেই বাস্তবে গণমাধ্যম কখন ও মুক্ত হবে না বলে আমার মনে হয়।

কৃষ্ণ ভৌমিক


পাবনা।
৫-৫-২০