বিশ্বজুড়ে যখন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ প্রশাসনের সকলে রাতদিন পরিশ্রম করেও সামাল দিতে পারছেনা; তখন ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করলো ভিয়েতনাম ও কিউবা সরকার। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা যদি জনকল্যাণমুখি হয় তাহলে যেকোন সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। করোনা ভাইরাসের এই মহাসংকটে সেটা প্রমান করেছে সমাজতান্ত্রিক দুটি দেশ ভিয়েতনাম ও কিউবা।
করোন আক্রান্ত প্রথম দেশ চীন। এই চীনের পাশেই অবস্থান ভিয়েতনামের। ভিয়েতনাম সরকার জানিয়ে দিয়েছে এখনো পর্যন্ত করোনায় তাদের দেশে মৃত্যু নেই। ৯০ এর বেশি দিনে আক্রান্ত ২৬৮ জন । সুস্থ্য হয়ে উঠছে সবাই।
ছোট দেশ, সামনে চীনের বর্ডার তা সত্বেও বেঁধে রাখতে পেরেছে মহামারীকে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রেসিডেন্ট থেকে কর্মচারি, ডাক্তার থেকে অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনায় মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও উল্টো চিত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামে। বুধবার (২৯ এপ্রিল) দেশটিতে নতুন করে কোনও ভাইরাস আক্রান্ত ধরা পড়েনি। গত ১৩ দিনে কোনও কমিউনিটি ট্রান্সমিশনও হয়নি ভিয়েতনামে।
প্রায় ৯ কোটির ওপর জনসংখ্যার ওই দেশটিতে মোট করোনাভাইরাস রোগী পাওয়া গেছে ২৭০ জন, এরমধ্যে একজনও মারা যায়নি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সব রোগীদের সুস্থ করে তোলায় ভিয়েতনামের চিকিৎসকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
আর ‘কোভিড-১৯’ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ভিয়েতনাম পুরো দেশটাই লকডাউন করে দিয়েছিল। এতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়েছে।
গত ২ মার্চ সর্বনাশটা ঘটায় দেশটির একজন প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী। ইউরোপের তিনটি দেশ ঘুরে ওই ব্যবসায়ী ভিয়েতনামের হ্যানয় বিমানবন্দরের দায়িত্বরত কর্মচারীদের পরীক্ষা ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েন দেশে।
বিমানবন্দরের পরীক্ষায় ফাঁকি দিলেও ভিয়েতনামের পুলিশ তাকে ঠিকই আটক করে। এরপর জানা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। এরপর ভিয়েতনাম সরকার একটা বড় পদক্ষেপ নেয়। সেটি হল, ওই নারী যে বিমানে এসেছিলেন, তার সব যাত্রীকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।
তিনি যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই রাস্তা জীবাণুমুক্ত করা হয়, সেই পথের ধারে বাস করা প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হয়।
ভিয়েতনাম এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় যা করেছে, তা পুরো বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে টানা ২১টি বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে ভিয়েতনামের বীরজনতা। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগর তীরের এক বিস্তীর্ণ জনপদে বয়ে গিয়েছিল অবিরাম এ রক্তের স্রোতধারা। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সে যুদ্ধে জয় হয়েছিল মুক্তিকামী মানুষেরই। অনাগত কাল ধরে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নে প্রেরণা যোগানোর ইতিহাস তৈরি করা সেই জনপদের নাম ভিয়েতনাম।
কিউবার সফলতা
কিউবা সমাজতান্ত্রিক একটি দ্বীপরাষ্ট্রের নাম। বর্তমানে দেশটিতে জনসংখ্যা ১ কোটি ১৫ লাখের মত। কিউবানরা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অচলাবস্থার জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সমাজতান্ত্রিক এই দেশটি। মানবতা রক্ষার যুদ্ধে নিজেদের সাহস, দক্ষতা আর চিকিৎসাজ্ঞান নিয়ে এগিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপন্ন দেশগুলোতে চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে কিউবার চিকিৎসক ও নার্সের বিভিন্ন দল।
দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯টি দেশে মেডিকেল দল পাঠিয়ে কিউবা একটি অসম্ভব রেকর্ড তৈরি করেছে।
দেশটি থেকে ইতালি, অ্যান্ডোরা, অ্যাঙ্গোলা, জ্যামাইকা, মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলাসহ ১৯টি দেশে নতুন চিকিৎসক দল পাঠানো হয়েছে। আর্জেন্টিনা, স্পেনসহ আরও কয়েকটি দেশের অনুরোধ তাদের পাইপলাইনে আছে। এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক চিকিৎসক ও নার্স ওই সব দেশে তারা পাঠিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি কিউবার চিকিৎসকদের চাহিদাও বাড়ছে।। বিশ্বের ৫৯টি দেশে কিউবার ২৯ হাজারের বেশি পেশাদার চিকিৎসক কাজ করছেন। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে হাজারো চিকিৎসক পাঠাচ্ছে দেশটি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিউবার চিকিৎসকদের চাহিদা বেড়েছে বলে দেশটি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেডিকেল টিম সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছে দেশটি। অসম্ভব এই সফলতার পিছনে কাজ করেছে দেশ দুটির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যা শুধুই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। (লেখক: ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক. কলাম লেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।