সবশ্রেণীর মানুষদের জীবনের উৎকর্ষ-অপকর্ষের সূবিচার হয় তাদের ‘চরিত্র’-পরিচয়ে। মানুষদের ”জীবন এবং কর্মের” মহিমায় তাদের চরিত্রের আলোকেই পায় দীপ্তি। সকল মানুষ তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অনুসারেই কাজ বা চিন্তা করে এবং সেই অনুযায়ী যেন সমাজজীবনে ভূমিকা রাখে। মানুষের জীবনে চরিত্র যে তার অহংকার ও সম্পদ। জনৈক দার্শনিক বলে ছিলেন, মানুষ হচ্ছে তিন প্রকার। একশ্রেণীর মানুষ হলো খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করে যাদের দরকার হয় সবসময়েই খাদ্য। আরেক শ্রেণীর মানুষ হলো, ঠিক ওষুধের মতোই যাদের দরকার হয় মাঝে মাঝে। আরেক শ্রেণীর মানুষরা হলো, রোগের মতো যা তাদের কখনো যেন দরকার হয় না। এ মানুষরা এই তিনটি বিষয় নিজ থেকে বিশ্বাস করে কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এখানে বৃহৎ ভুমিকা আছে তাইতো তাঁরা এমন আচরণেই কথা কপচায় এবং দাপটের সঙ্গেই চলে। যার যেটা শক্তিশালী সে সেটা নিয়ে অহংকার করে। সুতরাং, সৃষ্টিকর্তা তাদের অহংকার একনিমেষেই পরিবর্তন করে দিতেও পারেন। মানুষের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু বোকামীর কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তাইতো এই জগতের মানুষরা দাম্ভিকতা প্রকাশ করে এবং অহংকার করে।
সৃষ্টিকর্তা তাদেকে দেয় উজ্জ্বল শোভা ও সমুন্নত মহিমা। ফুলের সম্পদ যেমন তার সৌন্দর্য কিংবা সুরভি, আবার মানুষের সম্পদ তেমনি যেন চরিত্রশক্তি। নানা সদগুণের সমন্বয়েই যেন সব মানুষ হয়ে উঠে চরিত্রবান। মানুষদের সাথে সেই রূপ আচার আচরণ করো যেমন তারা পছন্দ করে। কিন্তু নিজের ইচ্ছা বা পছন্দ মাফিক আচরণ কর না। তাতে তারা কষ্ট পায়, একজনের কোনো রোগ হয়না কিন্তু সে ব্যক্তি রোগী ব্যক্তিকে অবহেলা করে বনজঙ্গল কিংবা রাস্তায় রোগীকে ফেলে চলে যায়। কিযে নির্মমতা ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ এই সমাজে আছে। তাদের যদি কোনো সময়ে এমন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েই যায় তখন তাদের উপায় কি, তারা একবারেও ভাবে না। সদাচারণ, সত্যবচন, সৎসংকল্প এবং সৎ জ্ঞান হয় তার জীবনে আদর্শ। মানুষ হিতৈষী হয় তার জীবনব্রত নিয়ে।সে মানুষ কোথায়, সমাজ কি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।ভূল করা দোষের কথা নয় বরং ভূলের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকা দোষণীয়। দেখা যাচ্ছে দিন দিন যেন ভুলের উপর ইচ্ছা করেই হাবুডুবু খাচ্ছে। চারিত্রিক দৃঢ়তাও মানুষদের বিন্দুমাত্র খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময় আমাদের জানা ছিল, চারিত্রিক গুণাবলীর স্পর্শে সমাজের অধম ব্যক্তিরাও নিজের কুলষিত জীবনকে সুধরে নেয়ার যেন সুযোগ পায়। এখন সুধরে নেওয়া তো দূরের কথা মানুষ অহংকারী হয়ে উঠছে। এখানে অহংকার শব্দটাকে যেই ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা, তার উদ্দেশ্য অবশ্যই ভিন্ন আঙ্গিকে। অহংকার গুরুগম্ভীর শব্দটা অবশ্যই মানুষের কাছে পরিচিত হলেও তা নেতিবাচক একটি শব্দ। মানুষ তাকে নিজস্ব আত্মায় ইচ্ছাকৃতভাবে ধারন করে অনেক বড়াই করে। এ ধরনের কথাকে ভেবেই বলা যেতে পারে যে, অহংকারী মানুষরা কখনোই ভালো মানুষদের কাছে সম্মান পায় না। কিসের এতো অহংকার? অনেক সবুজ ধান গাছের পাকা ধান গুলো কাটছে একটি মহল, কিন্তু সেই ধান গাছের ছবিতে দেখা যায় পাকা ধাপগুলি যেন চোখেই পড়ছে না। জমির মালিকও বলছেন, পাকা ধান কাটা হচ্ছে। মালিক কি ভয়েই বলছেন আমাদের জানা নেই। হয়তো বা ক্ষমতার দাপটে মালিকে বলিয়ে নিতেও পারেন। ক্ষমতার দাপট কিংবা দাম্ভিকতাটাও- সে সকল মানুষের আত্মঅহংকার পর্যায়ে পড়ে বলেই মনে করতে পারি।
ঘুম ভাঙলে সকাল, আর না ভাঙলে পরকাল। অহেতুক এতো অহংকার বা দাপট কেন? মানুষ নিজের অবস্থান নিয়ে অনেক গর্ব এবং অহংকার করে থাকে কিন্তু ভেবে দেখেও না যে, তাঁর যা অবস্থান রয়েছে তার পেছনে যে কার না কারো অবদান আছে। সুতরাং বলা যেতে পারে অহংকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন ও গর্বিত কুলাঙ্গার। খুব ‘বেশি অহংকার’- কখনোই ভালো হয় না। তিন ধরনের মানুষ অনেক বেশি ‘অহংকার’ করে থাকে। বেশি শিক্ষিত হলে, বেশি সুন্দর হলে, হঠাৎ করেই তারা বড়লোক হলে। তা ছাড়াও আরো একটি কারণ রয়েছে, তাহলো অল্প বিদ্যা অর্জনকারী ব্যক্তি নিজকে অহেতুক আড়াল করে রাখার জন্যেই যেন এক ধরনের ভাব ধরে অহংকার করে। সুতরাং জ্ঞানীরা মূর্খদেকে চিনতে পারে কেননা সে জ্ঞানী। পক্ষান্তরে মূর্খ জ্ঞানীকে চিনতে পারে না, কেননা সে মূর্খ। তাই তো সামাজিক ভাবে কে জ্ঞানী আর কে মূর্খ বুঝা কঠিন। শুধুই এই সমাজে লক্ষ্য করা যায় দাম্ভিকতা কিংবা অহংকারের বেড়াজালে সাধারণ মানুষরা বন্ধি। অ-মানুষের জ্ঞান কবে হবে, যে অধিকার আদায়ের পেছনে চেষ্টা চালানো হয় তা কখনই বৃথা যায় না। সততা ও নিষ্ঠার সহিত অহংকার পরিহার করেই কি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার করা যায় না। কেনই বা এই দেশের হতদরিদ্র অসহায় মানুষদের ‘খাদ্যদ্রব্য’ ক্ষমতার দাপটে চোরি করে খেতে হবে।
সমগ্র পৃথিবীতে আজ অবধি যত সত্য কথাগুলো জানা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সত্যি কথা অহঙ্কার পতনের মূল আর মানুষের নায্য চাহিদা থেকে বঞ্চিত করা। তাই তো ‘জন রে’ বলেছিলেন, ‘লোভী ও অহংকারী মানুষকে বিধাতা সবচাইতে বেশী ঘৃণা করে।’ তাই বলতেই হয় যে, “যতক্ষণ অহংকার ততক্ষন অজ্ঞান। যতক্ষণ নিজ স্বার্থ ততক্ষণ পতন”। অহংকার কিংব অত্মসাতে মতোই স্বার্থ থাকতে কখনোই মুক্তি হবে না। নীচু হলে তবে উঁচু হওয়া যায়, চাতক পাখির বাসা নিচে কিন্তু উঠে খুব উঁচুতে। এ ধরনের ‘অহংকার নয়’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করলেই বড় হওয়া যায়, সকল শ্রেণীর মানুর জাতি সম্মান করে। যাদের আত্ম বিশ্বাসের অভাব এবং আত্মবিশ্বাসেই অন্ধ তারা অন্য মানুষকে ভালো কাজ থেকে কি ভাবে সরিয়ে রাখা যায় সে চেষ্টাই করে থাকে। তারা নিজেরা পারে না বলেই যেন, অন্যকে কৌশলে ফেলে বিভিন্ন চাল ঘটিয়ে চাল চোরি এবং অন্যান্য কিছু পেলেই ভোগ করে থাকে। আবার অতি আত্মবিশ্বাস ও অহঙ্কারহীন মানুষকে নিজ চেষ্টা কিংবা ”সঠিক কিছু শেখা” থেকেই বিরত রাখতেও চেষ্টা করে। দাম্ভিকতার শিক্ষায় বেশকিছু মানুষরাই এক দিন না এক দিন নিজ স্বার্থ ও অহংকার দেখিয়েই কখন পতন ঘটে যায় তা টেরও পায় না এবং পরেই আপসোস করে। অহংকার এটি অনেক ‘খারাপ গুণ’। এটা অবশ্যই শয়তানের বৈশিষ্ট্য, ঠিক শয়তান মানুষকে দিনে পর দিন অহংকারী রূপেই বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। তাই “সৃষ্টি কর্তা” মনেই করেছেন, অহংকারী মানুষ গুলো কখনোই ভালো হয় না। দিনে দিনেই তাদের অন্তরকে ‘আলোহীন’ করে দেয়। তাদের অন্তরটিতেই যেন একসময়- ‘পরিপূর্ণ অহংকার’ জায়গা করে নেয়। আর কোনোভাবে সরাতে পারে। ভালো চেতনা নষ্ট হয়ে যায়। সর্ব প্রথম সৃষ্টি কর্তা এবং তাঁর সৃষ্টির ওপর যে অহংকার করেছিল সে হচ্ছে, অভিশপ্ত ইবলিস। সুতরাং অহংকার ইবলিসি চরিত্র।
অহংকারী মানুষ খুব জঘন্য স্বভাবের হয়। এটা আসলে আত্মার মারাত্মক মরন ব্যাধি। মানুষ নিজেকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম বলে মনে করলেই যেন মনের মধ্যে এক ধরনের আনন্দের হাওয়া বয়ে যায়। এমন– আনন্দ হাওয়ার কারনে মন ফুলে ফেপে উঠে। এটাই অহংকার।মনে রাখতে হবে যে অহংকার ও বড়াই মানবাত্মার জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং মারাত্মক ব্যাধি, যা কিনা মানুষদের নৈতিক চরিত্রকে শুধু কলুষিতই করে না বরং মানুষদের সত্যের পথ থেকে খুব দূরে সরিয়ে ভ্রষ্টতা বা গোমরাহির পথে নিয়ে যায়। কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষদের অন্তরে অহংকার ও বড়াই এর অনুপ্রবেশ ঘটে ঠিক তখনই তার জ্ঞান, বুদ্ধির ওপরেই তা বিস্তার করে। নানা প্রলোভন ও প্ররোচনার মাধ্যমেই খারাপ আত্মা খুব শক্ত হস্তেই টেনে নিয়ে যায় কু-পথে এবং বাধ্য করে সত্যকে অস্বীকার বা বাস্তবতাকেই প্রত্যাখ্যান করার মতো অনেক কিছু। ইচ্ছা জাগ্রত থাকেও না খুব ভালো কাজে। ‘অংহকারী মানুষ’ সবসময়ে চেষ্টা করে অন্যের হক কুক্ষিগত করে নিজের ফায়দা লুটা যায় কিভাবে। তাদের কাছে খুব সজ্জিত ও সৌন্দর্য মণ্ডিত ব্যপারগুলো হয়ে ওঠে যেন কিছু বাতিল, ভ্রান্ত, ভ্রষ্টতাসহ গোমরাহি মতোই নানা বিষয়। যার কিনা কোনো বাস্তবতা খোঁজে পাওয়া যায় না। এ সবের সাথে আরও যোগ হতে থাকে, যেই মানুষ যতোই বড় হোক না কেন, তাকে অহংকারী’রা নিকৃষ্ট মনে করবে এবং তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করে তাকে অপমান করবে। দেখা যায় অনেক মানুষরা আবার প্রতিভার কারণে প্রাথমিকভাবেই সফল হয়, কিন্তু সেই মানুষরা অহঙ্কারের কারণেই যেন নিজের সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। অহংকারী মানুষেরাই তার নিজের ভুল ত্রুটি কাউকে দেখতেও দেয়না। ইগো তাকে অন্ধ করে দেয়, সে যতটা না বড়, নিজেকে তার চেয়েও যেন বেশি বড় করে দেখতে শুরু করে। কারও পরামর্শ এরা নেয় না। মনে করে নিজেই সবচেয়ে ভালো বোঝে।সুতরাং এমন ধরনের মানুষ সমাজে অহরহ চোখে পড়ে নিজেকে নিয়েই অহংকার করতে করতে ধ্বংস হয়েছে। সমাজ তাদেরকে অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখে। সুতরাং পা পিছলে পড়ে যাওয়া লজ্জার কথা নয়। বরং যথাযথ সময়ে উঠে না দাঁড়ানোই লজ্জার ব্যাপার। এ মানুষদের লজ্জা হবে কবে।
অহংকার- তো তারাই করে, যাদের কোনো ধরনের গুন নেই। অহংকার শব্দটির প্রতিশব্দটা হচ্ছে: আত্মাভিমান অহমিকা ও গর্ব। অহংকার অথবা গর্ব এমন একপ্রকার আবরণ, যা মানুষের সকল মহত্ত্ব আবৃত করেও ফেলে। মানুষের সকল মানবীয় গুণের বহিঃপ্রকাশ হলো মহত্ত্ব। এইসব মানবীয় গুণাবলি দিয়েই মানুষেরা অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। হয়েছেও ‘সৃষ্টির সেরা’ জীব। মহৎ মানুষরা অহংকারী ও আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে, দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করেছে। তাই, তাঁরা সকল প্রকার “হীনতা, দীনতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা বা অহংকার” থেকে মুক্ত থাকে। তাঁরা সবসময় দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে চিন্তা করে, নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে যায়। তারা বিশ্বাস করেন, মরিচা- যেমন লোহাকে বিনষ্ট করে, তেমনি অতিরিক্ত অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে।সৎ মানুষেরা এও বিশ্বাস করেন যে, অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দেন, তার প্রভাব-প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন এবং তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন। যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় কিংবা বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে বেইজ্জতি করেন। সুতরাং, অহংকারী হওয়া ঠিক নয়, গারিবদেকে ঘৃণা করা উচিত নয়। তাদের যা প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব ছিন্ন করে অর্থ উপার্জন করতে যেও না। কারণটা, বন্ধুত্ব স্থাপনই যেন নিজস্ব অর্থাপর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম তা স্মরণ রাখতে হবে।
লেখক:নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।