এই তো, ক’টা দিন আগেও আমাদের মনে ছিল আনন্দ। শিশুরা নেচে-গেয়ে বেড়াত, ছুটির ঘণ্টা বাজলেই লাফিয়ে দৌড়াতো, কাকডাকা ভোরে বয়স্করা হাঁটতে যেত, ছুটির দিনে পরিবার-আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণবন্ত আড্ডা জমতো- এসব তো নিছক গল্প নয়। এ তো ছিল আমাদের জীবনের-ই প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু থমকে গেলাম আমরা, থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী চোখের সামনে সবকিছু কেমন পালটে দিল। হতাশা, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, একঘেঁয়েমি আর নিত্য নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ- এভাবেই একেকটি দিন পার করছে মানুষ।
পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, জীবন কখনও থেমে থাকে না। বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হয়। তাই, কঠিন এই পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিজে সুস্থ থাকা এবং পরিবারের সদস্যদের সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি।
সুষম ও পুষ্টিকর খাবার যে কোনো রোগ বিশেষ করে সংক্রামক রোগের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি জোগায়। যেহেতু করোনাভাইরাসের ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, ফলে বিজ্ঞানীদের দেহে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাতে অন্তত জীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি অর্জন করা যাবে।
অন্যদিকে গরমও পড়েছে বেশ। অতিরিক্ত দাবদাহে বছরের এই সময়টাতে জ্বর, সর্দি, গলাব্যথা, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিদের বিশেষ ঋতুতে বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ার রেওয়াজ আছে। সেই অনুযায়ী, অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি গরমকালে পাতে থাকে তিতা ও টক জাতীয় খাবার। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজনে টক ও তিতা খাবার থাকেই। ঘি দিয়ে ভাজা নিম পাতা, করলা ভাজি, তিতা পাট শাক, কাঁচা আমের টক, তেঁতুল ও টমেটোর চাটনি- এগুলোই চৈত্রসংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে শুধু চৈত্র সংক্রান্তি নয়, পহেলা বৈশাখেও বাড়িতে বাড়িতে রান্না হয় টক ও তেতো খাবার।
অবশ্য নাগরিক জীবনে পালিত হওয়া চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখের খাবার-দাবারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারপরও পার্বণ দুটিকে ঘিরে দেশি খাবারের নানারকম আয়োজন তো থাকেই।
এখনো গ্রাম-মফস্বল-হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে গ্রীষ্মকালে টক ও তেতো খাবারের গুরুত্ব অনেক। এ জাতীয় খাবার খেলে গরমকালের নানা রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলেই তাদের বিশ্বাস। আসলেই কী তাই? আসুন জেনে নেই কিছু কথা।
গ্রীষ্মকালে বসন্ত রোগ বেশি হয়। প্রাচীনকালে বসন্ত রোগের ওষুধ ছিল না। এই রোগ এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, অনেকে মারাও যেত। সেইসময় একমাত্র চিকিৎসা ছিল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বসন্ত রোগ প্রতিরোধ করতে তেতো খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো। বসন্ত রোগীকে নিমপাতা ফোটানো পানি ঠান্ডা করে গোসল করানো হত।
এখন বসন্ত রোগের চিকিৎসা আছে। এ রোগে মানুষ মারা যেতেও দেখা যায় না আর। তবে বসন্ত রোগ প্রতিরোধে তিতা খাবারের অত্যন্ত কার্যকারিতা খুঁজে পেয়েছেন চিকিৎসকরা।
এ ছাড়া জ্বর, সর্দি, গলাব্যথার মতো রোগগুলো গ্রীষ্মকালে প্রকট আকার ধারণ করে। অতীতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এসব রোগের সমাধানে টকজাতীয় খাবার খেতে বলা হত। গরম কাটিয়ে দেহে স্বস্তিভাব ধরে রাখতে এসব খাবারের পরামর্শ দিতেন চিকিৎসকরা।
এখন আসি, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এই যুক্তির তাৎপর্য কতটুকু?
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, ভিটামিন সি দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ঠান্ডাজনিত যে কোনো সমস্যায় চিকিৎসকরা ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এখানেই শেষ নয়। একাল কিংবা সেকাল- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গরমকালে আরও কিছু খাবারের উপকারিতা জানা গেছে। তরমুজ, টক দই, শজনে ডাঁটা, কচি কাঁঠালের ঘন্ট, আম ডাল, ডাবের পানি- সুস্থ থাকতে এ খাবারগুলো অত্যন্ত সহায়ক। তবে রান্না করতে হবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে। মাছ, মাংস রান্নায় কম মশলা ব্যবহার করতে হবে। ভাজাভুজি যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।
করোনা সংক্রমণ এবং গরমকালের নানা শারীরিক সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই- বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে তার কিছু পরামর্শ হলো-
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন: বারবার হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির সময় রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করা, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া- এই পরামর্শগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
পুষ্টিকর খাবারদাবার
সুষম খাবারকে পুষ্টিকর খাবার বলা হয়। আমাদের মূল খাবার ভাত বা রুটি। ভাত ও রুটির সঙ্গে মাছ, মাংস কিংবা ডিম রাখি। অর্থাৎ প্রোটিন জাতীয় এসব খাবার তো খেতেই হবে, তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শাক-সবজি ও ফলমূল তালিকায় রাখতে হবে। ভিটামিন সি জাতীয় ফল খুবই কার্যকর। বাজারে এখন আনারস, শসা, পেয়ারা, আপেলসহ নানা ধরনের ভিটামিন সি যুক্ত ফল পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন ২ ধরনের ফল খাওয়া ভালো। নিদেনপক্ষে ১টি ফল খেতেই হবে। ঘুমানোর আগে এক কাপ দুধ খাওয়া ভালো।
ব্যায়াম জরুরি
অনেকে মনে করেন, কেবল পুষ্টিকর খাবার খেলেই সুস্থ থাকা যায়। এধারণা একেবারেই ভুল। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শরীরকে সচল বা অ্যাকটিভ রাখতে হয়। তা না হলে শারীরিক নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আবার ঘরে থাকার কারণে ওজনও বেড়ে যেতে পারে। তাই ঘরেই হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম দরকার
ঘুম কম হলে দুশ্চিন্তা, হতাশা ও মানসিক চাপ বেড়ে যায়। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভালো ঘুম দরকার। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
দুশ্চিন্তা কমাতে হবে
দুশ্চিন্তা থেকে শরীরে নানা রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া দুশ্চিন্তা করলে ঘুম ভালো হয় না, কারো কারো খাবারে অনীহা দেখা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, বিষণ্নতাসহ নানা সমস্যাও হতে পারে। তাই দুশ্চিন্তা কমাতে হবে। এ জন্য যোগব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী।
করোনাকালে খাবারদাবারের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সতর্কতা জরুরী বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন-
যেকোন ফল বাজার থেকে কিনে আনার পর ভালো করে ধুয়ে শুকনো পরিষ্কার কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে রাখতে হবে।
এইসময় কিছু ফলের খোসা বাদ দিয়ে খাওয়া ভালো।
যেমন: আপেল, পেয়ারা, শসা ইত্যাদি। আর শাক-সবজি ভালো করে ধুয়ে রান্না করলে তাপে জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়।
থালা-বাসন পরিষ্কার রাখতে হবে।
সবজি, ফলমূল কাটার আগে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
এছাড়া রান্নার আগেও হাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন উপায়ে রান্না করতে হবে।
খাবারে যেন মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর ইত্যাদি পোকামাকড়গুলো না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এইসময় সুস্থ থাকতে সাপ্লিমেন্টের চেয়ে বাসায় বানানো পুষ্টিকর খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলছেন গবেষকরা। পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবার খান এবং সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলুন। সুস্থ থাকুন।