পৃথিবীর এমন অদ্ভুত চিত্র আগে কখনও দেখা হয়নি। দূর্ভিক্ষ লাগলেও মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে খাবারের সন্ধান করে, হয়ত বাহিরে গেলে মিলতে পারে খাবার। যুদ্ধ লাগলেও মানুষ ঘর থেকে বের হয়, হয়ত এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে মুক্তি হতে পারে। মিলতে পারে আশ্রয়, খাদ্য, নিরাপত্তা। কিন্তু করোনাভাইরাসের ছোবলের এই সময়টা এমন জটিলতর হয়ে গেছে যে মানুষ বাহিরে বের হতে পারছে না, কোথাও পালাতে পারছে না। ঘর ছাড়া কোথাও নিরাপত্তার জায়গা নেই। আর কোথায় পালিয়ে যাবে? পৃথিবীর সর্বত্র আজ করোনা মহামারী চলছে। পৃথিবীজুড়ে দূর্ভিক্ষ আসন্ন। কোটি কোটি মানুষের জীবন শঙ্কার মুখে। ঘরের বাহিরে বের হলে জাপটে ধরতে প্রস্তুত করোনাভাইরাস। একজনের থেকে আরেকজনকে, এভাবে শতজন থেকে হাজারজন, লাখজনকে আক্রান্ত করার সক্ষমতা রাখে প্রাণঘাতি এই করোনাভাইরাস, ইতোমধ্যে যার প্রমাণ মিলেছে। দেশে দেশে লাখ ছাড়িয়ে গেছে আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যুর পরিসংখ্যানও কম নয়। পৃথিবীর মানুষগুলো খেলার স্কোরের মত প্রতিদিন সেসব গুণছে। কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারছে না বিজ্ঞান কিংবা ধর্ম। বলা হচ্ছে, শুধু ঘরে থাকলেই চলবে আপাততঃ। এই হল জীবাণু যুদ্ধ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য বহন করে। অস্ত্রের যুদ্ধ হলে লাখো মানুষ মরলেও কারও না কারও আঘাতে আক্রমণকারীরা বিনাশ হত। কিন্তু করোনাভাইরাসের সাথে কারও পেরে ওঠার সক্ষমতা নেই, এখনও সক্ষমতা তৈরি হয়নি বলে পৃথিবীজুড়ে কান্না আর এক অজানা সংঙ্কা কাজ করছে- আমরা কি বাঁচতে পারব?
আমরা অতীতের দিনগুলোর সাথে বর্তমানকে কোনোক্রমেই মেলাতে পারি না। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, বিজ্ঞানের মাইলফলক অগ্রযাত্রা পৃথিবীর প্রায় দেশকে বিশ্বায়নের পথে ধাবিত করেছে। দেশে দেশে আছে পারমাণবিক বোমা, আছে সুউচ্চ অট্টালিকা। আছে উন্নত চিকিৎসালয়। গুটি কয়েক রোগ ব্যতিত সকল রোগের প্রতিষেধক আছে। কিন্তু হঠাৎ চীনে জন্ম নেওয়া নোবেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পৃথিবীকে সে সময়টুকু দিচ্ছে না। দৃশ্যঃত, সব অচল করে দিয়ে চলছে ভাইরাসটির সর্বগ্রাসী মারণ খেলা। সকল কমিউনিটিতে তার অণুপ্রবেশ খুবই জোড়ালো ও রহস্যজনক। এমন নয় যে কিছু দেশে এটির প্রভাব পড়েছে, কিছু দেশ করোনামুক্ত। এমনটা হলে এর একটি বন্দোবস্ত এত দিনে হয়ে যেত, তা সুনিশ্চিত। সবাই যখন মৃত্যুর দোড়গোড়ায়, তখন স্বাভাবিক ব্রেন কাজ করানো বড্ড মুশকিল হয়ে পড়েছে। মানুষের মগজে মৃত্যুর চিন্তা ঢুকে পড়লে, সকল কিছুর প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়, তুচ্ছ হয়ে পড়ে জীবনের সকল আয়োজন। কেননা, এই জীবনের সাথে মৃত্যুর পরের জীবন জৈবিকভাবে অসর্ম্পকিত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা।
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের জার্নিটা দীর্ঘতর হয়েছে। আরও কত কী যে সে করবে, তা আমাদের ধারণার বাহিরে এখন। গবেষণা যেসব তথ্য ও উপাত্ত দিচ্ছে, সে অবধিও পৌঁছাতে পারে। আশা করতে পারি, হয়ত এরই মধ্যে আবিষ্কার হয়ে যাবে করোনার প্রতিরোধের ভ্যাকসিন। তখন করোনাভাইরাসকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু যত দিন তাকে নির্মূল করতে না পারছি, তত দিন মানতে হবে আমাদের স্বাস্থ্য নির্দেশনাসমূহ। সচেতন হতে হবে সকলকে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে কঠোরভাবে। এই কাজটি পৃথিবীর অনেক দেশই করতে পারছে না। বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে এক্কেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা বিরাজমান। এসব দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন জোড়াল। সবচেয়ে বড় কথা, বোধ শক্তিটা অনেক কম। এমন যে আমার তো করোনা হয়নি। আমি হাট-বাজার-মাঠে-ঘাটে ঘুরলে আপত্তি কীসে? মানুষ ঘরে থাকতেই চাইছে না। একে তো করোনাভাইরাস, দুইয়ে তো ‘ভাল্লাগে না’ রোগ সমস্ত সিস্টেমটাকে নষ্ট করার পথে। মানুষ লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন শব্দগুলোর সাথে পরিচিত নয় বলে সচেতনতার জায়গা তৈরি করতে সকলেরই হিমসিম খেতে হচ্ছে। পুলিশ-প্রসাশনকে গান গেয়ে সচেতন করতে হচ্ছে। তারা বুঝে গেছে মারপিট করে আইনকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না কখনও। এবং অনেকেই ভাবছে, করোনাকাল কেটে গেলে এই ধরনের মানবিক আচরণগত সিস্টেমটা প্রবলভাবে কাজে লাগতে পারে। পৃথিবীকে মানবিক করে তুলতে ভালোবাসাই যথেষ্ট।
করোনাকালে এসে শ্রেণিবৈষম্য প্রবলভাবে জেগে উঠেছে। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত নামে তিনটি ধারা হয়ে গেছে দৃশ্যমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই বলা যেতে পারে- যারা সচ্ছল, তারা এই করোনাকালের লকডাউনকে আমলে নিয়ে নিজেদেরকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে। মধ্যবত্তিরা না ঘরে বন্দী থাকতে পারছে, না বাহিরে বেরিয়ে কাজ পাচ্ছে। কখন যেন সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে যায়। তারা পাচ্ছে না সরকারের ত্রাণ, কিংবা ধনীর দান। সবচেয়ে করুণ এবং মানবেতর অবস্থায় আছে নিম্নবৃত্ত মানুষগুলো। মিল-কারখানা, স্কুল-কলেজ, পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের আয়ের পথটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো ভবিষ্যতসঞ্চয়ের পরিকল্পনা করতে পারে না। তাই তাদের কোনো প্ল্যান নেই যে কোনো মহামারীর সময় নিজেদের নিরাপদ রাখব কীভাবে। তাদের ঘরে বন্দী করে সুস্থ রাখা কোনো রাষ্ট্রেরই সম্ভব না। এখানে রাষ্ট্রের সিস্টেমগত ত্রুটিও হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিতে বলে দেওয়া হচ্ছে, কেউ ঘরের বাহিরে বের হবে না। যখন দেখল, যারা বাহিরে বের হতে না পেরে ক্ষুধায় মারা যাওয়ার উপক্রম, রাস্তায় পড়ে দুচারজন মারা যাচ্ছে, তখন তাদেরকে ত্রাণ দিতে বাহিরে ডাকা হল। তারপর কী হল? এক্কেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! আস্তে আস্তে সবাই বলতে লাগলো- আমাদের করোনা হবে না। বাংলাদেশের বাজারের পরিস্থিতি দেখলে কারও মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বালাই নাই। আর সম্ভব কি এভাবে চলা? আমার মনে হয়, এত বেশি সংখ্যক মানুষকে শুধু কথায় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না।
করোনা নিয়ে কথা বলতে গেলে বারবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গই চলে আসবে। কেননা, এ দেশের পরিস্থিতি আমরা চোখে দেখছি। নিদারুণ সিস্টেম লসের কারণে দেশের করোনা পরিস্থিতি আজ নাজুক। দিন যত যাচ্ছে, করোনা টেস্টের হার যত বাড়ছে, তত বাড়ছে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। তাহলে এ থেকে বোঝা যায়, দেশে ধারণার চেয়ে করোনায় আক্রান্ত মানুষ আছে! তারা যেকোনো সময় সমস্ত দেশব্যাপি ছড়িয়ে দিতে পারে এই ভাইরাস। অথচ তাদের নির্দিষ্টকরণে আমাদের প্রস্তুতি যতসামান্য। যখন ক্রমশ করোনা দেশে দেশে ছড়াতে আরম্ভ করল, তখন আমরা ভাবতে লাগলাম, আমাদের দেশে করোনা আসবে না। আর এটা ভেবে বসে থাকলাম। কিন্তু বিদেশফেরতরা ঠিকই করোনাভাইরাস বহন করে দেশে ফিরল। তখন আমরা বিমান চলাচল বন্ধ করতে পারলাম না। তখন আমরা চিহ্নিত করতে পারলাম না, কারা বিদেশ থেকে এসেছে। এই চরম ব্যর্থতার দায় আজ প্রতিটি মানুষ বয়ে নিয়ে চলেছে। পেটের ক্ষুধা কখনো লকডাউন মানে? তাইতো করোনাকে তোয়াক্কা না করে ছুটছে কাজে, অফিসে। চাকরি বাঁচানোর জন্য পায়ে হাঁটছে। ঘরে থাকলেও মরতে হবে, বাহিরে গেলেও মরতে হবে। আমাদের তো কিছু করার নেই। যাদের করার কথা ছিল, তারা তা না করে করোনাকে বিনোদন হিসেবে নিয়ে উদ্ভট সব মন্তব্য ছেড়েছিল গণমাধ্যমে। জাতির এই ক্রান্তিকালে তাদেরকে আর বাহিরে দেখা যায় না। সবাই এখন হোম কোয়ারেন্টিনে দিনযাপন করছে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচারে!
করোনাভাইরাস থাকবে না। চলে যাবেই একদিন না একদিন। কিন্তু তার দৃষ্টতা মানুষকে দেখিয়ে ছাড়বে। মানুষকে শিখিয়ে ছাড়বে- সৌজন্যতা কী, সামাজিক-পারিবারিক বন্ধন কী, মানুষের প্রতি মানুষের দূর্বলতার জায়গা কোথায়। মানুষকে সুবোধ হতে শেখাবে। যারা করোনার ছোবল থেকে বেঁচে যাবে, তারা নিজেদেরকে মানবিক করার চরম একটা সুযোগ পাবে। (সরকারি চাকরিজীবী হলে পাবে সর্বনিম্ন ৫লাখ টাকা।) সুন্দর পৃথিবী গড়তে করোনাকাল পরবর্তী দিনগুলো মাইলফলক হতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের সার্বিক সচেতনতায় করোনাভাইরাস নির্মূল হোক। আমরা ফিরে পাই নতুন পৃথিবী। করোনার এ যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না কারও। কত দিন ঘরবন্দী হয়ে থাকা যায়? এখন টের পাচ্ছি, পাখিকে খাঁচায় রাখলে তার কেমন লাগে? পশুকে চিড়িয়াখানায় রাখলে তার কেমন লাগে? নিরাপরাধীকে জেলখানায় রাখলে তার কেমন লাগে? এই বোধ থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা- করোনাকাল কেটে এক নির্মল পৃথিবী দাও তুমি। আমরা ভালো হয়ে যাব। আমরা দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে পৃথিবীকে মানবিক করে তুলব। করোনায় যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের পরিবারের প্রতি আমরা সমব্যথী। যারা করোনায় আক্রান্ত, তারা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসে, সে প্রত্যাশা করি সবসময়।
মোহাম্মদ অংকন : গল্পকার ও কলামিস্ট, ঢাকা।