পুর্ব প্রকাশের পর) (৩)
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের খ্যাতনামা প্রবীণ ভাইরোলজিষ্ট ডাক্তার অনিতাভ নন্দী বলেছেন, নিজের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আশপাশটা পরিষ্কার রাখতে। ব্যবহার করা পানি যেন জমে না থাকে। নোংরা পরিবেশে যেমন থাকতে পারে করোনাভাইরাস, তেমনি কোভিড থাকতে পারে মলদ্বারেও। তাই শৌচকর্মের সময় শুধু হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ছেড়ে দেবেননা। জীবাণুনাশক লিকুইড সোপ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। না হলে জামা-কাপড় এবং বসার জায়গা থেকেও সংক্রমিত হতে পারে।
কোভিড-১৯ এর আক্রমণের ফলে মানব সভ্যতা যেন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইতোমধ্যে সবার জানা হয়েছে করোনা কবলিত পৃথিবীর কথা। মহা পরাক্রমশালী দেশ থেকে শুরু করে ছোট বড় ২ শতাধিক দেশই আজ করোনাভাইরাস কবলিত। মাতৃগর্ভ হতে সদ্যভুমিষ্ট শিশু সন্তান থেকে অশিতিপর বৃদ্ধ কাউকেই ছাড়ছেনা এ নোভেল করোনাভাইরাস। রাহুগ্রাসের মতো গ্রাস করে ফেলছে গোটা বিশে^র লাখ লাখ মানুষকে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বিশ^ বিখ্যাত সব জ্ঞানী-গুনি- গবেষক থাকতে করোনাভাইরাসের মত এক অদৃশ্য শক্তির লাগাম টেনে ধরার আজো কোন পথ তারা খুজে পাচ্ছেননা। অর্থাৎ এপর্যন্ত কোন দেশেই করোনাভাইরাসের কার্যকর কোন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাইতো বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন টোটকা ওষুধ, মনগড়াভাবে লতাপাতা ইত্যাদি অবাধে ভক্ষন করে চলেছে। এব্যাপারে সাউথ চায়না মর্ণিং পোষ্ট সংবাদপত্রের একটি খবরে জানা গেছে যে, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে একজন নারী দেড় কেজি কাঁচা রসুন খেয়ে ফেলে। এতে করে তার গলায় প্রদাহ শুরু হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আমাদের দেশে এক শ্রেণীর মানুষ গুজবের সোয়ারিতে চড়ে হুজুক তোলে যে, থানকুনির পাতা খেলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই রাস্তার আশে-পাশে, বাঁশ ঝাড়ে,বন-বাদাড়ের থানকুনির পাতা দু একদিনেরর মধ্যেই সাবাড় হয়ে যায়। চট্রগামের সীতাকুন্ডে কুড়িয়ে পাওয়া এক প্রকার গাছের ফল (ক্ষুদ্র মার্বেল আকৃতির) ভিজিয়ে পানি পান করলে করোনা মুক্ত হওয়া যাবে বলে হঠাৎ করে বিভিন্ন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সেই ফল খুঁজতে রাস্তায় নেমে পড়ে হাজারো মানুষ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিজ নিজ বাড়ির সামনের রাস্তায় বা বাড়ির আশে-পাশে এটি কুড়িয়ে পায় বলে তাদের দাবি। এদিকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বললেন, এসব গুজব ছাড়া কিছুই নয়। এই ফলের পানি খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে যেতেপারে লোকজন।
মার্কিন টেলি ইভানজেলিষ্টি ধর্ম প্রচারক জিম বেকার সে দেশের মানুষকে রূপার পানি পান করতে পরামর্শ দিয়েছেন। কলোইডিয়ার সিলভার মুলক এমন পানি যেখানে রূপার ক্ষুদ্র কণিকা মেশানো থাকে। তার অনুষ্ঠানে এক অতিথি দাবি করেন, এই পানি কয়েক ধরণের করোনাভাইরাস মেরে ফেলতে সক্ষম। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে, কোভিড-১৯ এর উপর এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
বাংলা দেশের জনৈক মুফতিতো স্বপ্নযোগে করোনাভাইরাসের ওষুধের সন্ধান পেয়েই গেছেন। নাকিঁ সুরের সেই ওয়ায়েজিন তাঁর ওয়াজে বয়ান করেছেন ইটালির মামুন-মারুফ তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। অনেক কষ্টে মামুন সেই মুফতি সাহেবকে তার স্বপ্ন টেলিফোনে বর্ণনা করেছে। ভাইরাস তার সাথে কথা বলেছে। তিনি নিজেও স্বপ্ন দেখেছেন করুনা!ভাইরাস তার সাথে ৬ তারিখ রাতে কথা বলেছে। ……..। অপর এক মুফতি তো চ্যালেঞ্জ করে বসেন যে,কসম!, আপনার কাছে করোনা আসবেনা। ঠিক কিনা…। কথা বলেননা ক্যান। উপস্থিত মুসুল্লিগণ সমস্বরে বলেন ঠিক ঠিক…..।
কিন্তু করোনাভাইরাস কারো কথাই কর্ণপাত করছেনা। সে বৈদ্য-কবিরাজ, ডাক্তর-নার্স, রাজা-মহারাজা, আমলা, ফয়লা কাউকেই ছাড় দিচ্ছেনা। বিশে^র শত শত দেশের মত অবশেষে গত ৮ মার্চ -২০২০ তারিখে নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিট-১৯ নীরবে নিভৃতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয় খুবই কমল। তাই তারা যেকোন জিনিষি সহজে উপলব্ধি করতে গিয়ে প্রায়শ্চয়ই দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে। অতি সহজে কোন কিছুতে যেন ভয় পায়না তেমনি সহজে কোন কিছু বিশ^াস করতে চায়না। তবে জাতি হিসেবে বাঙালি বীরের জাতি। ১৯৭১ সালে তার প্রমাণ মিলেছে। সেসময় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়ে বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা জাতি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস একটানা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালিরা পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে কুপোকাত করে ফেলে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের কাছে নিজেদের মাথা হেট করে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একশ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষ ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে পাক ওয়াতনের সৈন্যদের সাথে আঁতাত করে বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিলো। শুধু কি তাই তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসর হয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে লুট-তরাজ করে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মা-বোনদের ইজ্জত হরণ করে। তারা নির্বিচারে মানুষজনকে হত্যা করে উল্লাস প্রকাশ করে।
আজো তাদের প্রেতাত্মা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অবস্থান করছে। তাইতো তারা সুযোগ পেলেই এদেশের মানুষের কল্যাণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমুলক কথাবার্তা বলে, অপপ্রচার চালায়। যেমনটি করেছিলো যুদ্ধাপরাধি মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদির দন্ডের রায়ের দিন। সেই রাতেই গুজব রটনা করে যে, দেলোয়ার হোসেন সাঈদিকে চাঁদে দেখা গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রি শেখ হাসিনা। তিনি করোনাভাইরাসের মত প্রাণঘাতি ব্যাধিকে রুখে দিবার জন্য দেশের মানুষকে একত্রিত হবার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তা মেনে নিতে পারছেনা। তাই তারা বিভিন্ন ধরণের গুজব এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে লিপ্ত রয়েছে।
(চলবে)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।