সারাদেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে কয়েক জনের মৃত্যু, অনেক এলাকা লকডাউন

সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যুসহ নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ জন। এ নিয়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১২তে আর আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩। তবে এদিন কোন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে যেতে পারেননি। সেই সঙ্গে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই ঢাকার বাইরের।

সোমবার (০৬ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা অনলাইন ব্রিফ্রিংয়ে এসব তথ্য জানান।

নারায়ণগঞ্জ:

মরণ ব্যাধি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার পরই রয়েছে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের স্থান। এ জেলায় দুই জনের মৃত্যুসহ ২০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। জেলার এমন পরিস্থিতিতে পুরো জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল আমিন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ব ব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নাসিক এলাকা দিন দিন সংক্রমিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুইজন মৃত্যুবরণ করাসহ একাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর প্রশাসন বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করেছে।

জামালপুর:

জেলার মেলান্দহ উপজেলায় প্রথমবারের মতো করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তার নাম আশরাফ হোসেন টোকন (২৬)। তিনি মেলান্দহের বীরঘোষেরপাড়া গ্রামের আ: করিমের ছেলে বলে জানা গেছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ইউএনও তামিম আল ইয়ামীন জানান, অফিসিয়ালি কাগজপত্র না পেলেও করোনা পজিটিভ বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, আশরাফ হোসেন গত বুধবার থেকে জ্বর-গলা ব্যাথায় আক্রান্ত হন। খবর পেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা ৪ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ শেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে পাঠান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়ার যায়।

ইউএনও আরো জানান, ৪ এপ্রিল আশরাফ হোসেনের বাড়িসহ আরো ১০টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।

কুমিল্লা:

দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ভেলানগর গ্রামের কবির মিয়া (৪৫) এর মাঝে করোনার উপসর্গ সন্দেহে রবিবার রাতে ঢাকায় তার নমুনা প্রেরণ করা হয় বলে উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. শাহীনুল আলম সুমন জানান।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে কবীর মিয়ার পরিবারসহ ভেলানগর গ্রামের ৬টি পরবারকে প্রশাসন লকডাউন করেছে।

মৌলভীবাজার:

জেলার রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের আকুয়া গ্রামের সানচু মিয়া (৪৫) নামে এক ব্যক্তি করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার পর আইইসিডিআরে পরীক্ষায় পজেটিভ পাওয়া যায়।

এতে গ্রামটি লক ডাউন করে গ্রামবাসিদেরকে হোম কোয়ারিনটাইনে রাখা হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদ আহমদ এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।গত শনিবার তিনি মারা যান। ওই দিনে তাকে দাফন করা হয়।

এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ নূরুল হক জানান,রবিবার কুলাউড়া পৌরসদরের ৬জনের উপসর্গ দেখে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়।এদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ২জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রয়েছেন। এছাড়া একটি বাসা লক ডাউনে রাখা হয়েছে।

ফরিদপুর:

জেলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। আজ সকাল ৯টায় তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই বৃদ্ধের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায়। চারদিন আগে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর নিহত ওই ব্যাক্তির বাড়ির আশে পাশের অন্তত ১শ পরিবারকে কঠোরভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন।

এছাড়া জেলার ভাঙ্গা উপজেলার চুমুরদী ইউনিয়নের রায়পাড়া গ্রামে সোমবার ভোররাতে করোনা উপর্সগ নিয়ে সালাম মাতুব্বর(৭০) নামের এক বৃদ্ধ মারা গেছে।তিনি উক্ত গ্রামের আইজুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে।

ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডাক্তার মহসিনউদ্দিন জানান, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট এবং লিভারে সমস্যা নিয়ে তিনি কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। সোমবার ভোররাতে তিনি মারা গেলে তার শরীর থেকে শ্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।

উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে মৃত ব্যক্তির পাশের বাড়িতে মালয়েশিয়া ফেরৎ দুই বাংলাদেশি বসবাস করেন।

রাজশাহী:

করোনা উপসর্গ নিয়ে রবিবার রাতে ববিতা খানম (২৬) নামের এক গৃহবধূকে উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। ববিতা খানমের স্বামী ডাক্তার আলামিনকেও হাসপাতালে নজরদারীতে রাখা হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ও উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিবার কর্মকর্তা ডাক্তার আনোয়ার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, সোমবার ববিতার খানমের নমুনা সংগ্রহ করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ববিতা খানম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মরত ডাক্তার আলামিনের স্ত্রী এবং উপজেলার বামন ঘিয়ালা গ্রামের বাসিন্দা।

বেশকিছুদিন ধরে আমার সাথে ডাক্তার আলামিনসহ একটি টিম বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিপিই না পাওয়া প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়াই তাদের শনাক্ত করা হয়। তিনি আরো জানান, যদি ববিতা খানমের দেহে করোনা ভাইরাস পজেটিপ হয়, তবে টিমের সবাইকে আইসোলেশনে যেতে হবে।

এদিকে, করোনার সতর্কতায় রাজশাহী জেলা ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সভায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, দেশে ধীরে ধীরে করোনার রোগী বাড়ছে। তাই বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে হিসেবে আমরা রাজশাহীকে লকডাউনের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এছাড়া, রামেক করোনা ল্যাবে সোমবার আরও ৩১টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ল্যাবের ইনচার্জ ডা. সাবেরা গুলনাহার জানান, ৩১টি নমুনার মধ্যে রাজশাহীর ৬টি, বগুড়ার ৬টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১০টি, নাটোরের ৮টি ও নওগাঁর ১টি। রামেকে ১লা এপ্রিল ল্যাব চালুর পর এনিয়ে ৯৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় চিকিৎসাধীন নার্সকে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ:

সরকারি হিসেবের বাইরের জেলার তাড়াশ উপজেলায় করোনা ভাইরাস উপসর্গ নিয়ে এক পোশাক শ্রমিক মারা গেছেন। সোমবার (৬ এপ্রিল) দুপুর ২ টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ওই পোশাক শ্রমিকের বাড়ি উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের সরাপপুর এলাকায়।

স্থানীয়রা জানান, গত বুধবার (১ এপ্রিল) হাঁচি-কাশি নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। এরপর তার জ্বর ও প্রচণ্ড গলা ব্যথা শুরু হয়। একই সাথে পাতলা পায়খানাও হতে থাকে। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে সোমবার বেলা ১২ টার দিকে তাকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমলরুল কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানে করোনা আতঙ্কে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে বগুড়াস্থ শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। বগুড়ায় যাওয়ার পথে বেলা ২ টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জামাল মিয়া শোভন বলেন, মৃত পোশাক শ্রমিকের বাড়িতে মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনে নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

নোয়াখালী:

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকায় এক শিশুর (১২) নমুনা সংগ্রহ করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। সোমবার (৬ এপ্রিল) ওই শিশুর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে ওই শিশুর বাড়ি লকডাউন করেছে উপজেলা প্রশাসন। সংগ্রহ করা নমুনা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সংক্রামণ ব্যাধি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

টাঙ্গাইল:

জেলার নাগরপুরে শামছুল মিয়া (৫৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু শোকে তার মা ফাতেমা বেগমের (৭৫) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (৬ এপ্রিল) দুপুর ১২ টার দিকে উপজেলার বেকড়ার মুশুরিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই এলাকার লোকজনের মধ্যে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, আমি স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি মৃত শামছুল দীর্ঘদিন যাবৎ লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিল। আর শামসুলের মা চোখের সামনে ছেলের এমন মৃত্যু দেখে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

এছাড়া জেলার গোপালপুর উপজেলায় করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আরো একজন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। আজ সোমবার (৬ এপ্রিল) ভোর রাতে তিনি উপজেলার নগদাশিমলা এলাকার নিজ বাড়িতে মারা যান। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইসলামী ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা মোতাবেক এবং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি।

গোপালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলীম আল রাজী জানান, করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা। আপাতত তার পরিবারের সবাইকে হোম কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছে।

বরিশাল:

বরিশালে করোনা ইউনিটে ভর্তির ২০ মিনিটের মাথায় এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ওই ইউনিটে তিনজন রোগীর মৃত্যু হলো। সোমবার বিকাল ৫টা ১০ মিনিটে জ্বর, গলাব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন ইউসুফ আলী (৫০)। ভর্তির ২০ মিনিটের মাথায় সাড়ে ৫টায় তার মৃত্যু হয়।

শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন জানান, গলাব্যাথা ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ওই রোগী করোনা ইউনিটে ভর্তির কিছুক্ষণ পর মারা যান। কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা জানার জন্য পরীক্ষা করতে হবে। এজন্য তার নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় প্রেরণ করা হবে।

বরিশাল জেলা প্রশাসক এস,এম অজিয়র রহমান জানান, বিষয়টি জানার পর ওই বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। বর্তমানে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের করোনা ইউনিটে ৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যাদের মধ্যে চারজন নারী ও পাঁচজন পুরুষ।

সূত্র : ইত্তেফাক