চলমান মহামারী করোনা ভাইরাস: যে কোন বিপর্যয় মুমিনদের জন্য ঈমানী পরীক্ষা


 ১৪ শত বছর পূর্বে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিশ্রুতি দেয়া প্রতি বছর বিপর্যয় কিংবা গজব দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বর্তমান সময়ে তা বাস্তব প্রতিফলন হয়েছে।যে কোন বিপর্যয়  মুসলমানদের তাওবা করতে উদ্বুদ্ধ করে নিজেকে শুধরে নিতে ও সতর্ক হতে নির্দেশ দেয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি দেখে না যে তাদের প্রতিবছর একবার বা দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়? এরপরও তারা তাওবা করে না, উপদেশ গ্রহণ করে না!’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৬) মহামারী সম্পর্কে মহানবী (সা) এর ভবিষ্যদ্বাণী আজকাল আয়নার মত পরিষ্কার। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, “কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, এরপর তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারি, বকরির পালের মহামারির মতো।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৩১৭৬)বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। এই প্রাণঘাতী  ভাইরাস নিঃসন্দেহে মহান তাআলার আযাব।আল্লাহ তাআলা অতীতের বিভিন্ন জাতি-গোত্রকে মহামারীর মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি বনি ইসরাইলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার অবশিষ্টাংশই মহামারী।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)চলমান মহামারী করোনা ভাইরাস সহ যে কোন কঠিন বিপর্যয় মুৃমিনদের জন্য ঈমানী পরীক্ষা। মুমিনের জীবনে কোনো দুঃখ নেই। মুমিনের জীবন কল্যাণে ভরপুর।দুঃখ -দুর্দশা,অভাব অনটন, বিপদ -মুসিবতই হচ্ছে ঈমানের পরিচয়। হাদীসের ভাষায়, “দুনিয়া মুমিনদের জন্য কারাগার, আর কাফেরদের জন্য জান্নাত স্বরূপ।” মহান তাআলা ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা, জান ও মাল এবং ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করব। (হে পয়গম্বর!) আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।” (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫)কুরআন মজীদে এসেছে, “যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।” (সুরা আল-মুলক, আয়াত ২)কুরআন মজীদে আরো আছে, “আলিফ লাম মীম। মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি’ – তার একথা বলেই পার পেয়ে যাবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমিতো তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তোমাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত ১-৩)হাদীস শরীফে এসেছে, নবী (সা) কে একবার প্রশ্ন করা হল যে কোন মানুষ সবচেয়ে বেশী বিপদগ্রস্ত হয়? তিনি বললেন :”নবীগণ, তারপর নেককারগণ, তারপর তাদের নিকটবর্তীগণ। ঈমানের দৃঢ়তা অনুযায়ী মানুষকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ঈমান যদি সুদৃঢ় হয় তবে বিপদাপদও বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। আর ঈমান যদি হালকা হয় তবে বিপদাপদও হালকা ধরনের হয়। “(ইবনে মাজাহ) হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আনাস (রা) থেকে বর্ণিত।তিনি বলেন :রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ যখন তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ সাধনের ইচ্ছা করেন, তখন তাকে তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে বিপদে নিক্ষেপ করেন। আর যখন তিনি তাঁর কোন বান্দার অকল্যাণ সাধনের ইচ্ছা করেন, তখন তাকে তার অপরাধের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অতঃপর তিনি তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেন।”হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, “বিপদ যত মারাত্মক হবে, প্রতিদান তত মহান হবে। আর আল্লাহ্ যখন কোন জাতিকে ভালবাসেন, তখন তাদেরকে (বিপদে ফেলে) পরীক্ষা করেন।আযে ব্যক্তি তাতে (বিপদে) সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি বিদ্যমান। আর যে ব্যক্তি তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি বিদ্যমান।” (তিরমিযী, হাসান, হাদীস নং ২৩৯৬)হাদীস আরো আছে, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর! সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। আর এ বৈশিষ্ট্য কেবল মুমিনের। তারা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে শুকর আদায় করে। আর অসচ্ছলতা বা দুঃখ-মুসিবতে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে। সবকিছু তার জন্য কল্যাণকর। (সহি মুসলিম, হাদিস : ২৯৯৯)।চলমান মহামারী করোনা ভাইরাস সহ যে কোন কঠিন বিপর্যয় মুৃমিনদের জন্য রহমতস্বরুপ। যে সব বিপর্যয়ে মুসলমানরা মারা গেছে তাদের কিসের ভয় ?  কিসের চিন্তা ?হাদীসের ভাষায়, মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ। হাদীস শরীফে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি উত্তরে বলেন—মহামারী  একটা আযাব, আল্লাহ যার ওপর ইচ্ছা পাঠান। তারপর আল্লাহ তাআলা মহামারীকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দেন। কোনো বান্দা যদি মহামারী আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং নিজ বাড়িতে অবস্থান করে,  ধৈর্য ধারণ করবে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় থাকবে; এবং এই বিশ্বাস রাখবে—আল্লাহ তাআলা যদি তার তাকদিরে লিখে না থাকেন, তাহলে মহামারী তাকে আক্রান্ত করতে পারবে না। তাহলে তার জন্য রয়েছে একজন শহিদের সমপরিমাণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারি, হাদিস নং-৬৬১৯, ৫৭৩৪; মুসনাদে আহমদ ২৬১৮২) হাদীস শরীফে আছে, আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ—মহামারিতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ২৮২৯) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, মহামারিতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ২৮৩০)ইদানীং কালে অনেক নাস্তিক মুরদাত প্রশ্ন তুলেছেন চলমান মহামারী করোনা ভাইরাস যদি আল্লাহর আযাব হয় তাহলে এর থেকে মুসলমানরা কেন রেহাই পাচ্ছে না?? তাদের জন্য এই জবাব যথেষ্ট। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, “আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা শুধু জালেমদের ওপরই তা পতিত হবে না, অন্য সবাইও এর শিকার হতে পারে। জেনে রেখো যে, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর।” (সুরা আনফাল: আয়াত ২৫)হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্নিত। আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, যখন জমিনের ওপর অপরাধ বেড়ে যায় তখন আল্লাহ সেখানে আজাব অবর্তীণ করেন। আমি এ কথা শোনার পর রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলাম, হে রাসুলুল্লাহ, যদি সেখানে কোনো সৎ ও নেককার বান্দা থাকে সেও কি সেই শাস্তি পাবে? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। সেও অন্য সবার মতই শাস্তি পাবে কিন্তু হয়তো আখেরাতের স্থায়ী জীবনে সে আল্লাহর করুনা দেখতে পাবে। আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।” (মুসলিম ও আহমাদ)হাদীস শরীফে আরো এসেছে, উম্মে সালামাহ (রা.) থেকে বর্নিত। আমি রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করেছিলাম, হে রাসুল, আমাদের মধ্যে নেককার লোক থাকার পরও কি আমরা শাস্তির সম্মুখীন হবো? রাসুল (সা.) বলেন, হ্যাঁ হবে। যদি সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায় তাহলে তাই হবে।” (মুত্তাফিকুন আলাইহি)তাছাড়া প্রত্যেক মুমিন বিশ্বাস করে যে কোন বিপর্যয়ের পর সুখ রয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,”আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন।” (সূরা ত্বলাক : ৭)কুরআন মজীদে এসেছে, “নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।” (সূরা ইনশিরাহ : ৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য যথাযথ  কুরআন-হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার পাশাপাশি চিকিৎসকের চিকিৎসা ও পরামর্শ গ্রহণ করার  তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : কলামিস্ট। মোবাইল: ০১৮২৫৮৬৬৪০৫