বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল খালেক

আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া গ্রামের ১৪ বছর বয়সী কিশোর আব্দুল খালেক। ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। বাবা মায়ের বড় সন্তান। পরিবারের সবার কাছে আদরের ছিল। এলাকার মানুষের কাছেও ছিল সমাদর। সুদর্শন, সৌম্য, ভদ্র, মেধাবী বহুগুণের অধিকারী এই কিশোর, শিশুকাল থেকেই ছিল অনন্য ব্যতিক্রমী স্বভাব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং সৃজনশীল মানসিকতা সম্পন্ন । পরিবার, সমাজ, দেশ, জনগন এগুলি নিয়ে শিশুকাল থেকেই ছিল তার ভাবনা। স্কুলে ছিলেন ক্লাশ ক্যাপ্টেন। মানসিকভাবে সবক্ষেত্রেই ছিল নেতৃত্ব দেবার গুণাবলী। এমন স্বভাবের কিশোরের সামনে এলো মহান মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৬৯ সালে গন-আন্দোলনের সময় কিশোর আব্দুল খালেক আটঘরিয়া স্কুলের ছাত্র ছিল। তখন আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ। চোখের সামনে দেখছে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। সে আন্দোলনে শরীক হয়েছে ছাত্র-শিক্ষক, তরুন-যুবক, নারী-পূরুষ, কৃষক-শ্রমিক সহ সর্বস্তরের জনগন । একটানা এক বছরের বেশী সময় ধরে চলা সেই আন্দোলনে মিছিল করেনি এমন ছেলে বা এমন মেয়ে পাওয়া ছিল কঠিন। শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্র আন্দোলনের ডামাডোল। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজোহা এবং পাবনার সুজানগরে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র আব্দুস সাত্তার পুলিশের গুলিতে নিহত হলে এই অঞ্চলে তীব্র গন-আন্দোলন গড়ে উঠে । ৬৯ এর গনআন্দোলন এবং ৭০ এর নির্বাচন এসব কিছুতেই কিশোর আব্দুল খালেক ছিলেন নিরস্ত্র সৈনিক। এর পরের ইতিহাস হলো – ইতিহাসের ইতিহাস।

১৯৭০ সালের শুরুতে বাড়ীর পাশে খিদিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হলো একটি হাইস্কুল। সেখানে আব্দুল খালেক প্রথম ছাত্র হিসেবে আটঘরিয়া স্কুল থেকে টিসি নিয়ে নব-নির্মিত খিদিরপুর স্কুলে ৭ ম শ্রেনীতে ভর্তি হলো । ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। ১৯৭২ সাল থেকে সেই স্কুলের নামকরন করা হলো ” শহীদ আব্দুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয় “। এক বছরের মাঝে সৃষ্টি হলো শত বছরের ইতিহাস।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস । পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে শুরু হলো তীব্র আন্দোলন। হরতাল, অবরোধ আর অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পর থেকেই মূলতঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মী গোটা দেশে একসাথে আক্রমন করে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করলো। শুরু হয়ে গেলো বাঙালীর স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান আর্মীদের নৃশংসতার মাত্রা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। লুটপাট করে বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। মা-বোনের সম্ভ্রমহানী করছে। এমন অবস্থায় লক্ষ লক্ষ লোক দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের তরুন-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে শরীক হচ্ছে। ঠিক এমনি একটি সময়ে আটঘরিয়ায় আনোয়ার হোসেন রেনু’র নেতৃত্বে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার একটি অগ্রগামী দল এলাকায় প্রবেশ করেন। তাঁরা এলাকায় প্রবেশ করে জনগনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করতে থাকেন। স্থানীয় তরুন-যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট করা এবং তাঁদের স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী শত্রুনিধন সহ ছোট ছোট অপারেশন করে অস্ত্র সংগ্রহের কাজ করতে থাকেন । অল্পদিনেই আটঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দল অনেক বড় দলে পরিনত হয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর। পবিত্র রমজান মাস। আটঘরিয়া থানার রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার আব্দুল মমিনের নেতৃত্বে একদল রাজাকার মাজপাড়া গ্রাম এবং খিদিরপুর আদিবাসী পল্লীতে হানা দেয়। সেখানে লুটপাট, নির্যাতন , অগ্নিসংযোগ সহ নারীদের শ্লীনতাহানি করতে থাকে। ঘটনার অদূরেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের বাড়ী। তাঁদের বাড়ীতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনুর সাথে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন । আব্দুল খালেকের বাবা আব্দুল হক শেখ হলেন আনসারের সাবেক কমান্ডার। উনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিতেন। শুধু তাই নয় মুক্তিপাগল এই মানুষটি তাঁর ১৪ বছর বয়সী ছেলে আব্দুল খালেককে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ভর্তি করিয়ে দেন। যাইহোক সেদিন রাজাকার বাহিনীর আক্রমন চলাকালে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন, রাজাকার বাহিনীকে আক্রমন করবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আনোয়ার হোসেন রেনু এবং পাশেই অবস্থানরত পাবনার নয়নামতি নিবাসী শাহজাহান আলীর নেতৃত্বধীন আরেকটি মুক্তিযোদ্ধার দল যৌথভাবে বেরুয়ান ও হাড়ল পাড়ার মাঝামাঝি নির্জন স্থানে অবস্থান নেন । রাজাকার বাহিনী তাদের অপারেশন শেষ করে ফিরে আসার মুহুর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যাম্বুশের মধ্য পড়লে যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে রাজাকার কমান্ডার মমিন সহ ৯ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা তোয়াজ উদ্দিন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী শহীদ হন। এটাই হলো আটঘরিয়ায় প্রথম যুদ্ধ। আর দ্বিতীয় যুদ্ধ সংগঠিত হয় এর ১৪ দিন পর ।

১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর। খিদিরপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম কোনায় বংশিপাড়া ঘাট। চন্দ্রাবতী নদীর অপর পাড়ে সোনাকান্দর গ্রাম। সেখানেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখসমর যুদ্ধ হয়।স্বাধীনতাযুদ্ধে পাবনা জেলার অন্যতম বড় যুদ্ধ। বেরুয়ান যুদ্ধের পরই পাবনায় অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ঐ এলাকায় সাঁড়াশী অভিযান চালায়। অত্র এলাকায় তখন আনোয়ার হোসেন রেনু এবং ঈশ্বরদীর ওয়াছেব কমান্ডারের নেতৃত্বাধীন দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রায় ৬০ জন সদস্য একত্রে অবস্থান করছিলেন। ঐদিন সকাল ১১ টার দিকে বংশীপাড়া ও সোনাকান্দর এলাকায় চন্দ্রাবতী নদীর পাড়ে ৫০/৬০ গজের ব্যবধানে পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা মুখামুখী হয়ে পড়লে তাদের মধ্য তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রায় ২ ঘন্টা সময় ধরে চলা সেই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর দলপতি ক্যাপ্টেন তাহের সহ প্রায় ১৩ জন সৈন্য নিহত হয়। অপর দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক সহ ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ।

শহীদ আব্দুল খালেকের লেখাটি এই প্রজন্মের যারা পড়বেন নিশ্চয়ই ক্ষনে-ক্ষনে তাঁদের অনেক বিষয়ে কৌতুহলের উদ্রেক হবে। এত ছোট এত কমবয়সী একজন কিশোর দেশের জন্য যুদ্ধ করতে করতে কেমন করে তাঁর জীবনটা উৎসর্গ করলেন। এ প্রজন্মের কেউ ভাবতে পারবেন? মহান মুক্তিযুদ্ধে স্কুলে ও কলেজে পড়া ছেলেরাই বেশী সংখ্যক যোদ্ধা ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল বেশী। এরাই যুদ্ধের সবচেয়ে সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেদিনের সেই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের কথা লিখতে গেলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁর পাশে থাকা এক সহযোদ্ধার বর্ণনা শুনে আঁতকে উঠতে হয়। উনি বলছিলেন, অকুতোভয় যোদ্ধা আব্দুল খালেক সেদিন রোজা ছিলেন। পাশের রামচন্দ্রপুর গ্রামের এক বাড়ীতে একসাথে সেহরী খেয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রেও পাশাপাশি ছিলেন। দীর্ঘসময় গুলাগুলি হওয়ায় এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে যাবার মত অবস্থা হলে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নির্দেশ আসে পিছু হটার। খালেক সহ কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা পাকিস্তান আর্মীর সাথে গুলি ছুড়ে সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন । পাশে থেকে খালেককে পিছু হটার কথা বলা হলে সে পিছু না হটে বাকীদের নিরাপদে সরে যাবার সুযোগ করে দিতে থাকেন । অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের কাউন্টার গুলিতে সতীর্থ যোদ্ধারা পিছু হটতে পারলেও এই বীর আর পালাতে পারেননি। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছন দিক থেকে ঘিরে ধরে আব্দুল খালেক সহ ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই বীরের এমন কথা বলতে গেলে এখনো তার সহযোদ্ধারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি সেনারা এলাকা ত্যাগ করলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল খালেকের মরদেহ তাঁর নিজ গ্রাম মাজপাড়ায় আনা হয় এবং ঐ গ্রামের কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর এলাকার জনগন খিদিরপুর স্কুলকে তাঁর নামে নামকরণ করে ” শহীদ আব্দুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয় ” করেন। স্কুলের নামকরনের মধ্য দিয়েই এই বীরের নামকে অম্লান করে রাখা হয়েছে। এতটুকু ছাড়া স্বাধীনতার এতবছর পরেও সরকারী বা বেসরকারীভাবে এই বীরকে প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়নি। পরিতাপের বিষয় অকুতোভয় সাহসী এই যোদ্ধা তাঁর প্রাপ্য সন্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এমন বীরদের রাষ্ট্রীয় পদক প্রদান করা দরকার ছিল। এমন বীরদের আত্মজীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা দরকার ছিল । তার শাহাদত বার্ষিকীতে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে স্মরণ সভার আয়োজন করা দরকার। এছাড়া প্রতিবছর তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা বা স্মরণ সভা করা প্রয়োজন। এ প্রজন্মের শিশু-কিশোর, ছাত্র- ছাত্রীদের মাঝে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের বীরত্ব গাঁথা ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো দরকার। পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল খালেকের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। (শেষ)

লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব
এবং
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়
আটঘরিয়া, পাবনা।