প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিন্দু পরিমাণ অনিয়ম সহ্য করা হবে না। সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ বা কোনো অনিয়ম যদি পাই, সে যেই হোক না কেন, তাকে রেহাই দেব না। মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে অর্থশালী-সম্পদশালী হয়ে যাবেন এমন অপচেষ্টা ভুলেও কেউ করবেন না। আগেই সতর্ক করলাম।’ গতকাল মঙ্গলবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের আটটি বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জেলা প্রশাসক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলার চিন্তাভাবনা এখন থেকেই আমাদের করতে হবে, পরিকল্পনা নিতে হবে। সংকটের সময় প্রয়োজন হলে যাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্য দেশকেও সহায়তা করা যায়, তার জন্য কোনো জমি বা জলাশয় যাতে অনাবাদি না থাকে, তা নিশ্চিত করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘কারো এক ইঞ্চি জমি যেন অনাবাদী না থাকে, কোনো জলাশয় যেন পড়ে না থাকে। এটা অব্যাহত রাখতে পারলে দেশের চাহিদা তো আমরা মেটাতে পারবই, অন্য দেশকেও প্রয়োজন হলে আমরা সাহায্য করতে পারব। যার যেখানে এতটুকু জমি আছে, ঘরের কোণে হলেও, যা পারেন, যেটা পারেন, একটা কিছু ফসল ফলান; তরিতরকারি করেন,? ফলমূল করেন বা হাঁস-মুরগির খামার করেন। অর্থাত্, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা উত্পাদন দরকার এখন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এবার নববর্ষে জনসমাগম করে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।’ আগামী ১৪ এপ্রিল শুরু হবে বাংলা ক্যালেন্ডারের নতুন বছর—বঙ্গাব্দ ১৪২৭। নতুন বছরে পুরোনো সব জীর্ণতা মুছে যাবে—এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রতি বছর নানা আয়োজনে বৈশাখের প্রথম দিনটি উদ্যাপন করে বাংলাদেশের মানুষ। বৈশাখের প্রথম সকালে চারুকলার যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হয়, তা এখন ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’। এখন নববর্ষের আয়োজন বন্ধের সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কষ্ট হলেও সেটাও আমাকে বন্ধ রাখতে হচ্ছে মানুষের কল্যাণের দিকে তাকিয়ে।’
করোনা ভাইরাস দুর্যোগের সুযোগে যাতে কোনো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব না হয়, সেজন্য সবাইকে আগাম সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কালকে রাতে যখন ঘুমাতে গেলাম, তখন মাঝে মাঝেই দেখলাম যে মশারা সংগীতচর্চা করছে। মশার গান শুনতে চাই না। করোনার সাথে যদি ডেঙ্গু আসে, সেটা আমাদের জন্য আরো মারাত্মক হয়ে যাবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা আছেন তাদের বলব, মশার হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য এখন থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
করোনা পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে আমরা চিন্তিত। রোহিঙ্গা ক্যাম্প যেন ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়, সেটা দেখতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি কোনো রকম কিছু হয়ে যায়, তাহলে খুবই ক্ষতি হবে।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বহিরাগত কারো প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘ক্যাম্পে বাইরের কারো যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী সবাই আছে, তারা কাজ করছে। আমাদের যারা আছেন তারাই সেবা দেবেন। বাইরের কেউ যেন সেখানে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘কোনো ধরনের গুজব কেউ যাতে না ছড়াতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক আছি। দাফন নিয়ে কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন। যারা ভাইরাসে আক্রান্ত নয়, তাদের নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবের বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ব্যাখ্যা দিতে গেলে প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘যারা এগুলো করার করবে। আমি ওদের কথায় পাত্তা দিই না, দেব না। এগুলো এখানে কোনো পুনরাবৃত্তির দরকার নেই। আমাদের দেশে কিছু লোক আছে, যে কোনো ঘটনা হোক, ঢোল নিয়ে নেমে পড়ে।’
ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা পিপিই নিয়ে জনমনে আতঙ্ক এবং যাদের দরকার নেই তারা পরছেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘পিপিই তাদেরই দরকার, যারা করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবা করেন। অযথা পিপিই পরার কারো কোনো প্রয়োজনই নাই। এর অপব্যবহার করবেন না। একই সঙ্গে এগুলো ডিসপোজালের কী ব্যবস্থা আছে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধকল্পে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকার ঘোষিত ছুটি ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। এছাড়া পরিবহন শ্রমিক শ্রেণি যারা আছেন, তারাও যাতে কষ্ট না পান, তাদের তালিকা আমি ইতিমধ্যে করতে বলেছি। তাদের যেভাবে সাহায্য করার দরকার আমরা সেই সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। আমাদের দেশটা ছোটো, কিন্তু জনসংখ্যা ব্যাপক। এর পরও আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। সেজন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ে রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজেদের সুরক্ষা নিজেদেরই করতে হবে। সবাই ঘরে থাকুন।’
করোনা উপসর্গ দেখা দিলে চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে কোনো লুকোচুরি করার সুযোগ নেই। লুকোচুরি করলে নিজের জীবনকেই ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হবে। জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছুটি ঘোষণার কারণে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যা হচ্ছে। কৃষক, চা-শ্রমিক, হিজড়া, বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যারা দৈনন্দিন কাজে যেতে পারছে না, তাদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সামাজিক কর্তব্য। সেখানে ১০ টাকা কেজি চালসহ নানা সহযোগিতা করা হয়েছে। তাদের কাছে সাহায্য ও খাদ্যদ্রব্য পাঠাতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে পড়ার আহ্বান :করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি অফিসের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ১ এপ্রিল থেকে শুরুর কথা থাকলেও স্থগিত করা হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা। ঘরে বসে পড়াশোনা করে মূল্যবান এই সময়টা কাজে লাগাতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘ঘরে বসে সবাইকে পড়াশোনা করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা আমার অনুরোধ। একটা সুযোগ এসেছে ভালোভাবে পড়াশোনা করার।’ তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে এখন থেকে প্রস্তুত করো। যখনই পরীক্ষা আসবে তখনই যেন পরীক্ষা দিতে পারো। একই সঙ্গে ক্লাস যেন ধরতে পারো, সেজন্য পড়াশোনা করতে হবে।’
বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি) ছাড়াও ভিডিও কনফারেন্সে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যুক্ত ছিল। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ভিডিও কনফারেন্সে সচিবালয় প্রান্ত থেকে যুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন।