আমাদের দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় সব সময় সাহসের সাথে সংগ্রাম করেছে। বন্যা-খরা, ঝড় কোনকিছুই সাধারন মানুষকে অচল করে দিতে পারেনি। এটা কথার কথা নয়, বারবার প্রমানিত সত্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকেও আমাদের অনেক শিক্ষা আছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ সংকট-‘করোনা ভাইরাস’। অচেনা ও অদৃশ্য এই অপশক্তির সাথে লড়াই চলছে সবর্ত্র। বাংলাদেশও এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। ইতিমধ্যে ২৬ মার্চ থেকে ৪এপ্রিল পযর্ন্ত সরকার সাধারন ছুটি ঘোষনা করে প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান নিতে বলেছে। অতি প্রয়োজনে বাইরে গেলেও এক সাথে দু’জন না চলে দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহারসহ সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছে। এগুলো নিশ্চিত করতে মাঠে পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও কাজ করছে। এখন সবচেয়ে বড় সহযোগিতার ক্ষমতা রয়েছে সাধারন মানুষের হাতে। নিজ নিজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তাদের দায়িত্ব। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। সরকারিভাবে সারাদেশে ত্রানসামগ্রি বিতরন চলছে। এর বাইরেও নানানভাবে চলছে সহযোগিতার কাজটি।
আমাদের দেশে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপের মালিক ও অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা কি এই সংকটে কোন ভূমিকা রাখছে-? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অসংখ্য মানুষের মনে। আসলে আমরা এখনো একেবারে অমানবিক হয়ে যায়নি। ঢাকাসহ সারাদেশে বহু মানুষ, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ঘরবন্দি মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছে। তারা সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে দেশের অন্যতম প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ পিপিই, মাস্ক বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে।
১৫ কোটি টাকার চিকিৎসা সামগ্রী দিলো বেক্সিমকো। দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ১০টি বিশেষায়িত হাসপাতালে সুরক্ষা পোশাক-পিপিই ও মাস্কসহ ১৫ কোটি টাকার সরঞ্জাম বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে বেক্সিমকো ফার্মা।
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৩০১ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করছে শিল্প গ্রুপ আকিজ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও আকিজ গ্রুপের উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলছে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তাদের নির্ধারিত জায়গায়ই হচ্ছে এই হাসপাতাল। তারা বলেছে, ৭দিনে তৈরি হয়ে যাবে হাসপাতাল। এখানে বিনা খরচে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ১০ কোটি টাকা দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের জন্যও হুমকি হয়ে এসেছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এরইমধ্যে দেশে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশাল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বসুন্ধরা গ্রুপও এগিয়ে এসেছে। দেশের এই শিল্পগোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে।তারা ৫হাজার সিটের একটি হাসপাতাল ৭দিনের মধ্যে তৈরি করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে।
যমুনা গ্রুপ উন্নতমানের পিপিই ও মাস্ক বিনামূল্যে সরবরাহ করবে।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে ‘সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’। বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার আগ্রাসী আক্রমণ অব্যাহত আছে। বাংলাদেশে এখনও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়নি। তবে শঙ্কা তো আছেই। করোনার বিস্তার ঠেকাতে পুরো দেশে অঘোষিত ‘লকডাউন’ চলছে।
এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা খেটে খাওয়া মানুষদের। তারা বাইরে যেতে না পারলে খাবার জুটবে কি করে! তাই সমাজের উচ্চবিত্তদের দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। ইতিমধ্যে অনেকে সাহায্যের হাতও বাড়িয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও পাশে দাঁড়াচ্ছেন অসহায়দের। ২৭ জনের একটি গ্রুপ তাদের বেতনের অর্ধেক (৩০ লাখ টাকা) দান করে দিয়েছেন। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই অসহায়দের খাবার ও সাহায্য দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্যবাহী ট্রেনের চালক ও বিভিন্ন কারখানায় জরুরি প্রয়োজনে কর্মরত শ্রমিকদের সুরক্ষায় ২শ’ সেট ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) দিয়েছে রেলওয়ে সরঞ্জাম সরবরাহকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কসমোপলিটন করপোরেশন।
কিছু মানুষের জন্য সাহায্য চাওয়ার ব্যপারটা একটু কঠিন। কারন তারা সাহায্য চাওয়ায় অভ্যস্ত না। এই মানুষগুলোর অভিব্যাক্তি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। তাদেরকে আমরা বলছি বিপাকে পড়া মানুষ। কেউ কেউ ভাবছেন করোনার আক্রমন মাত্র সপ্তাহের ব্যাপার। সেরকম না হলে আমাদের বিশাল সংখ্যক মানুষ বিপাকের সম্মুখীন হবে। আমাদের চারপাশের বিপাকে পড়া কিছু মানুষের জন্য ছিল মিরপুর ক্লাবের “ফুড ব্যাগ” প্রোগ্রাম। ৬শ’ কেজি চাল, ১২০ কেজি আলু, ৬০ লিটার তেল, ৬০ কেজি ডাল ইত্যাদি বিতরণ করা হয়েছে ৬০ জন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাঝে।
করোনার কারণে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে সেই টাকা অসহায়দের জন্য অনুদান দিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার নবদম্পতি।
তারা হলেন উখিয়া কুতুপালং এলাকার বখতিয়ার উদ্দীন মেম্বারের ছেলে হেলাল উদ্দীন ও রাজাপালং ইউনিয়নের ডিগলিয়াপালং এলাকার আবদুর রহিমের মেয়ে উম্মে সালমা।
গত ২৭ মার্চ তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছিল। করোনার কারণে তা বাতিল করে অসহায়দের জন্য ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন এই নবদম্পতি।
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস এর সংকটময় অবস্থায় নিজের জেলা হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে করোনার রোগীদের চিকিৎসার জন্য নিজের একটি গাড়ি চালকসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। তিনি বলেন, আমি নিজেই আমার বাসায় লকডাউনে আছি। এখন তো আমি আর কোথাও যাবোনা তাই আমার আর গাড়ির দরকার নাই। এর জন্য আমার নিজের গাড়িটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও মুমিন উদ্দিন চৌধুরীর কাছে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছি। তারা আমায় বলেছে দরকার হলে গাড়িটি নিবে। এছাড়া ১৬টি রেইন কোটও দিয়েছি তাদের ব্যবহারের জন্য।
সংগঠনের মধ্যে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর সীমিত আকারে হলেও সাধ্যমত কাজ করছে।
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কাগজ কুড়ানো অবস্থায় গত ২৭ মার্চ বিকেলে আতাবুর রহমান (৬০) নামের এক বৃদ্ধকে দেখতে পান রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) হামিদুল হক।
ডিসির সঙ্গে ছিলেন পৌর মেয়র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি। হঠাৎ ওই বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যান তিনি। এগিয়ে যান অন্যরাও। বিষয়টি দেখে ভয় পেয়ে যান বৃদ্ধ। ভয় পেয়ে হাতজোড় করে ডিসিকে বৃদ্ধ বলেন, ‘বাবা আমার যদি কোনও ভুল হয়, মাফ করে দেন, আমি আর বাজারে আসব না।’
হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়া বৃদ্ধকে ডিসির নির্দেশে সরকারি খাসজমিতে বৃদ্ধকে পাকা বাড়ি বানিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে তানোর উপজেলা প্রশাসন।
এছাড়াও সারাদেশে ব্যক্তি. সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে পাবনা, ঈশ্বরদীতে একাধি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে গৃহে থাকা অনেক দরিদ্র মানুষের কাছে খাদ্য-সামগ্রি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ঈশ্বরদীতে শামসুর রহমান শরীফ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
করোনা সতর্কতায় যখন অঘোষিত লকডাউন সবখানে, দরিদ্র পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তা কিভাবে যোগাড় হবে খাদ্য, ঠিক তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে পাবনা জেলা প্রশাসন।
এভাবে দেশজুড়ে একটি জাগরণ তৈরি হয়েছে। করোনা ভাইরাস আমাদের শুধু গৃহবন্দিই করেনি মানবতাকে ও স্পর্শ করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাঙালিরা প্রমান করছে শুধু তিন ফুট দুরত্বেই দাঁড়াবোনা, সেই দুরত্বে থেকে আমরা মানুষের সহযোগিতার জন্য হাত বাড়াবো। করোনা ভাইরাস তুমি যতই শক্তিশালী হওনা কেন আমরা বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে, সুশৃংখলভাবে সকল নিয়ম মেনেই তোমাকে পরাস্ত করবো। আমার দিকে তোমাকে আসতে দিবোনা, তোমাকে তাড়াবোই। জয় মানবসভ্যতারই হবে।
( লেখক: ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক/ কলাম লেখক।
সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।