স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, অযৌক্তিকভাবে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করবেন না, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনা মূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হবে, রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা
বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে গোটা বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশও এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনা ভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সবার প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব, ইনশাআল্লাহ।’
বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আবারও বলছি, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সবাই যার যার ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা ভাইরাস জনস্বাস্থ্যসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক থাবা বসাতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন। আমাদের ওপরও এই আঘাত আসতে পারে। এই ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উপদেশ আমাদের মেনে চলতে হবে। আমাদের যতদূর সম্ভব মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ থেকে স্বদেশে ফিরেছেন, সেসব প্রবাসী ভাইবোনের কাছে অনুরোধ, আপনাদের হোম কোয়ারেন্টাইন বা বাড়িতে সঙ্গনিরোধসহ যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। মাত্র ১৪ দিন আলাদা থাকুন। আপনার পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসী এবং সর্বোপরি দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এসব নির্দেশনা মেনে চলা প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সহজ হবে। ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি দিতে হলে রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নেবেন। যেখানে-সেখানে কফ-থুথু ফেলবেন না। করমর্দন বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন। মুসলমান ভাইয়েরা ঘরেই নামাজ আদায় করুন এবং অন্যান্য ধর্মের ভাইবোনদেরও ঘরে বসে প্রার্থনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আইইডিসিআরে হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। সরকার চিকিত্সার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চীনে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্রবন্দর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনসহ সব স্থলবন্দরের মাধ্যমে বিদেশফেরত যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯৮১ জন যাত্রীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে। জানুয়ারি মাস থেকেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া আরো তিনটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য পৃথক শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঢাকায় ১০ হাজার ৫০টিসহ সারাদেশে ১৪ হাজার ৫৬৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য ২৯০টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুত আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৩ হাজার পরীক্ষা কিট মজুত ছিল। আরো ৩০ হাজার কিট শিগিগর দেশে পৌঁছাবে। ঢাকায় আটটি পরীক্ষার যন্ত্র রয়েছে। দেশের অন্য সাতটি বিভাগে করোনা ভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলছে।’ তিনি স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসনের সদস্যবৃন্দকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে একযোগে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানান।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ করাসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২৪ মার্চ থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বলবত্ হয়েছে। এটি কার্যকর করতে জেলা প্রশাসনকে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সহায়তা করছেন। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ ৫০০ চিকিত্সকের তালিকা তৈরি করেছে, যারা জনগণকে সেবা প্রদান করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সঙ্গে সরবরাহ চেইন অটুট রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করবেন না। জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। সর্বত্র বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনা মূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভাষানচরে ১ লাখ মানুষের থাকার ও কর্মসংস্থানের উপযোগী আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিনা মূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একইভাবে বিনা মূল্যে ওষুধ ও চিকিত্সাসেবাও দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি নিম্ন-আয়ের মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিল্প উত্পাদন ও রপ্তানি বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই আঘাত মোকাবিলায় আমরা কিছু আপত্কালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য আমি ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যবসাবান্ধব বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিজে সর্বক্ষণ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। আমাদের এখন কৃচ্ছ তা সাধানের সময়। যতটুকু না হলে নয়, তার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। মজুত করবেন না। সীমিত আয়ের মানুষকে কেনার সুযোগ দিন।’ তিনি বলেন, ‘করোনার পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমরা এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ভিন্নভাবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জনসমাগম হয় এমন ধরনের সব অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সব জেলায় শিশু সমাবেশ ইতিমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই কারণে আমরা মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জনসমাগম না করে টেলিভিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার করেছি।’