অবৈধ ইটের ভাটায় উজাড় হচ্ছে ফসলি জমি

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই পাবনার ফরিদপুরে গড়ে উঠেছে ৯টি ইটের ভাটা। এরমধ্যে উপজেলার বেড়হাউলিয়া গ্রামে পাশাপাশি রয়েছে পাঁচটি ইটের ভাটা। কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে জনবসতি এলাকায় গত এক যুগে এই পাঁচটি ইটের ভাটা গড়ে উঠে। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে আশেপাশের গ্রামের ফসলি জমির মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে গত এক যুগে এলাকায় শত শত একর ফসলি জমি নষ্ট করে শতাধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। প্রশাসনের নীরবতায় প্রতিবছরই পুকুর খননের সংখ্যা বেড়ে উজাড় হচ্ছে ফসলি জমি। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বায়ু দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় ক্রমাগত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া প্রধান সড়কের সাথে একাধিক ইটভাটা হওয়ায় চলাচলকারী যাত্রীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবৈধভাবে ভাটা পরিচালনা করায় গত ২ সপ্তাহ আগে পরিবেশ অধিদপ্তর এই পাঁচ ইটভাটার মালিককে চার লাখ টাকা জরিমানা করে ভাটা একেবারে বন্ধের নির্দেশ দিয়ে যান। তবে কেউই তা কর্ণপাত না করে ইটভাটা চালু রেখেছে।


জানা যায়, ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী কৃষিজমি বা পাহাড়-টিলা অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত মজা পুকুর বা খাল-বিল বা খাঁড়ি বা দিঘী বা নদ-নদী বা হাওর-বাওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গার মাটি ব্যবহার নিষিদ্ধ। প্রধান সড়কের পাশে, জনবসতি এলাকায়, কৃষিজমি, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপনও বেআইনি। এমনকি উপজেলা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কে ভারী যানবাহনেইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করাও অপরাধ বলে গণ্য হবে।
কিন্তু পাবনার ফরিদপুরে বাস্তব চিত্র ভিন্ন, সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) সড়কের পাশে এবং নদীর তীরের ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে উপজেলার বেড়হাউলিয়া গ্রামে এই পাঁচটি ইটের ভাটা। এর আশেপাশেই রয়েছে বসতবাড়ি। এসব ভাটায় প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় বাঁশের গুড়ি। চুলার ময়লা ও কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এসব বসতবাড়ি সহ আশেপাশের এলাকা। ভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভুক্তভোগী এইসব বসতবাড়ির বাসিন্দারা প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না।

তবে এই পাঁচটি ইটভাটায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি। ভাটা মালিকদের দেয়া তথ্য মতে পাঁচটি ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে প্রায় পাঁচ কোটি ইট তৈরি হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে ইট উৎপাদনের পরিমাণ এর দ্বিগুণেরও বেশি। এসব ভাটায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির সিংহভাগই আশেপাশের গ্রামের ফসলি জমি হতে আসে। এতে গত ১০ বছরে এসব ভাটার ইট তৈরির কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে আশেপাশের গ্রামে শতাধিক পুকুর খনন করে শত শত একর ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করা হয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এসব ইটভাটার পাশের পারফরিদপুর গ্রামে আজাদুল ইসলাম ও নুর ইসলাম, বিল বকরি গ্রামে মুকুল রহমান, সাভার গ্রামে রমজান ও নায়েব আলী, খাগুড়বাড়িয়া গ্রামে মিস্টার আলী, ভেড়ামারা গ্রামে রতন সরকার ও পাথরঘাটা গ্রামে ঠান্টু প্রামানিক, টলটলিয়া পাড়া গ্রামে লিটন আলী সহ অনেকের ফসলি জমিতে পুকুর খনন কাজ শুরু হয়েছে। জমির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে লক্ষাধিক টাকায় মাটি বিক্রি সহ পুকুর তৈরি করে দেয়ার চুক্তি হয়েছে ইটভাটা মালিক এসব জমির মালিকদের মধ্যে। শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ট্রলি গাড়ি দিয়ে এসব মাটি নেয়া হচ্ছে ভাটায়। প্রতিদিন গ্রামীণ সড়ক দিয়ে শত শত ট্রলি গাড়ি চলায় সড়কের বেহাল অবস্থা হয়েছে। গত মাসে এস্কেভেটর মেশিন দিয়ে এসব পুকুর খনন শুরু করা হলে প্রশাসনের লোকজন একাধিক পুকুর খনন বন্ধ করে দেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরে এসব জমিতে আবারো পুকুর খনন শুরু হয়। তবে সুচতুর ভাটা মালিকরা এসব জমিতে এস্কেভেটর মেশিন ব্যবহার না করে এখন শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটার কাজ করাচ্ছেন। 
এসময় স্থানীয়রা জানায় গত বছরও পারফরিদপুর গ্রামের পথিক আলী, মুস্তাফিজুর রহমান ও আনিসুর রহমান, বিল বকরি গ্রামের বাচ্চু মিয়া ও মুকুল প্রামানিক সহ অনেকে তাদের কৃষি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে পুকুর খনন করেন। এসব পুকুরের আশেপাশের ফসলি জমি এখন নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

লাকার কৃষকরা জানান, ফসলি জমিতে পুকুর কাটা অবৈধ এটা এলাকার বেশিরভাগ মানুষই জানে না। তাই ইট তৈরীর প্রতি মৌসুমে অক্টোবর মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর কাটার হিড়িক পড়ে যায়। এসব পুকুরে মাছ চাষের ফলে আশেপাশের ফসলি জমিতে ফসল চাষাবাদে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে ফসল উৎপাদন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। প্রশাসনের উদ্যোগে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে এবং অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ফসলি জমি রক্ষা করতে হবে।


পুকুর খনন কাজ চলা পারফরিদপুর গ্রামের জমির মালিক আজাদুল ইসলাম বলেন, ফসলের দাম কম। তাই ফসল চাষাবাদ করে কৃষকের পোষায় না। কিন্তু মাছ চাষে অধিক লাভ হয়। এর ওপর পুকুর খনন করতে কোন খরচ হয় না। উপরন্তু ইটভাটার মালিকরা লাখ লাখ টাকা দিয়ে মাটি কিনে নেয়। এ কারণে জমির মালিকরা ফসল আবাদের চেয়ে পুকুর খননের দিকে ঝুঁকছে বেশি।

ফরিদপুর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও এমজেডআই ইটভাটার মালিক জহুরুল ইসলাম বলেন, ইটভাটার মালিকরা কারো কাছ থেকে জোর পূর্বক মাটি নেয় না। জমি কিংবা খাল-ডোবার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি পূর্বক মাটি কিনে নেয়া হয়। এতে জমির ক্ষতি হচ্ছে কিনা সেটা আমাদের জানা নেই। এসময় পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশ অমান্য করে ইট ভাটা চালু রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোন কেটে দেন।
ফরিদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহম্মদ আলী বলেন, কোনো এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের বিষয়ে জানতে পারলেই খনন কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। এরপরেও যারা পুকুর খনন কাজ করেই চলছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ইটভাটার অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাবনা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ফরিদপুর উপজেলায় কোনো ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র সহ অন্যান্য দপ্তরের কাগজপত্র নেই। দু’একটি ইটভাটা হাইকোর্টে রিট করে চলছে। বাকি সবগুলো পুরোপুরি অবৈধ। দুই সপ্তাহ আগে এস্কেভেটর মেশিন ও দমকল বাহিনীর নিয়ে অভিযান চালানো হয়। সে সময় ভাটার চুলা পানি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পরে আর তা সম্ভব হয়নি। তবে পুনরায় অভিযান চালানো হবে। আর ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় ব্যবহার বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।