চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরে সিংড়া উপজেলায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন দফতর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ ,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর,পানি উন্নয়ন বোর্ড,বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আওতায় বদলে গেছে সিংড়া উপজেলা।এ উপজেলায় অর্থনৈতিক চাকাও আরো জোরে ঘুরতে শুরু করেছে যা পূর্বে ছিলো শুধুই স্বপ্ন।বর্তমান সরকারের উদ্যোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে অবহেলিত চলনবিল এলাকায় প্রাণের ¯পন্দন সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র কয়েক বছরেই সিংড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এই উপজেলায় এক হাজার প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
এর ইমধ্যে ১ শত ৪২ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮ শত ৪৬ টি প্রকল্পের আওতায় ২ শত ৩৭ কিলোমিটার সড়ক, ৯ শত ৩৩ মিটার ব্রিজ, উপজেলা কমপেক্স ভবন, মুক্তিযোদ্ধা ভবন, ভ‚মিহীন ও অস্বচ্ছলমুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান, ¯¬ইসগেট ও বিদ্যালয় ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ শেষ হয়েছে।সিংড়ায় ৯০ কিলোমিটার খাল খনন করেছে শেখ হাসিনা সরকার। যার কারণে ৬০ হাজার মেট্রিক ট্রন ফসল অতিরিক্ত ঘরে তুলতে পারছে কৃষকরা। কৃষি ক্ষেত্রে সরকার সফলতার সাথে কাজ করছে। কৃষিতে প্রযুক্তির ছোয়া দিয়েছে বর্তমান সরকার। কৃষি প্রধান এলাকা চলনবিল তথা সিংড়াকে আরো এগিয়ে নিতে সরকার চলনবিল উন্নয়ন প্রকল্প এবং বরেন্দ্র প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল । আর চলনবিলের মধ্যস্থলে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পাবনার চাটমোহর ,নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলা। এ দুটি উপজেলার একটি অংশের প্রায় ৩৫-৪০ টি গ্রামের হাজার, হাজার মানুষের আন্তঃ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গভীর চলনবিলের মধ্যে সড়ক না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হতো বছরের পর বছর ধরে। চলনবিল সিংড়া অংশের ১২ গ্রামের হাজারো মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার ডুবো সড়কেই (সাবমার্সিবল রোড এবং সিংড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে উত্তর দিকে নাটোর-বগুড়া সড়ক ধরে অর্ধ কিলোমিটার এগোলেই চৌরাস্তা। এখানেই বালুয়া বাসুয়া গ্রাম। উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে ঢুকে যাওয়া পিচঢালা সড়কটির শুরুতে চলনবিল গেট। এখান থেকেই চলনবিল নাটোরের সিংড়া অংশের বুক ফেঁড়ে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ চলে গেছে ২৮ কিলোমিটারের ডুবো সড়ক।
বালুয়া বাসুয়া গ্রামের কৃষক ইউনুস মন্ডল (৭৫) জানান,এ সড়কটি নির্মিত না হওয়ায় এখানকার উৎপাদিত শষ্য ধান , পাট, সরিষা পরিবহণের অসুবিধার কারণে মাঠেই সিংহভাগ ফসল জমিতেই নষ্ট হতো । এমন কি সবজি ফলমুল সহ এ সকল ফসল দুর্গম জনপদ হওয়ায় সড়কটি নির্মিত হওয়ায় আগে গাড়ি-ঘোড়া না চলতে পেরে পানির দরে বিক্রি করতে হতো তাদের কষ্টার্জিত উৎপাদিত ফসল। এখন তারা সহজে ফসল আনা নেওয়া করতে পারছে ।ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে ।
সিংড়া উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সড়ক হিসেবেই পরিচিত এটি। সিংড়া অংশে পড়েছে ১৪.৮৬০ কিমি। এর মধ্যে ৩৬০ মিটার ব্রিজ। চওড়া ২৪ ফুট। ১২ ফুট পাকা আর দু’পাশে শোল্ডার ১২ ফুট। তবে প্রথম তিন কিলোমিটার পিচের রাস্তা। এ অংশটুকু বেশি উঁচু। ডুববে না। পরের ১১ কিলোমিটার কংক্রিটের ডুবো সড়ক। প্রকল্প ব্যয় ২২ কোটি ২৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা । এই সড়কটি চলনবিলের মানুষের জীবনে গতি এনে দিয়েছে।
এলাকার কৃষক আনছার আলী চলনবিলের বুক চিড়ে ডুবন্ত সড়কটি নির্মিত হওয়া আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, ফসলের মৌসুমে বিশেষ করে বছরের আট মাস এলাকার হাজার হাজার লোক উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি তারা সরকারের এ উন্নয়নে খুশি।
চামারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রভাষক রশিদুল ইসলাম জানান, জনপদের ওই এলাকাটিতে এতদিন সড়ক না থাকায় হাজার হাজার একর জমির কোটি কোটি টাকার নানা ফসল ঠিকমত পরিবহণ করতে না পেরে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হতেন। যা থেকে তারা মুক্তি পেলেন ।
আড়তদার মীনহাজুল হোসেন জানান, আগে রাস্তাঘাট না থাকায় বর্ষাকালে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রিত থাকত। পরে শুটকি করা হতো অথবা ফেলে দেওয়া হতো।এখন তো আর সেদিন নেই। দিন বদলেছে। এখন ঢাকাসহ দেশের সব এলাকা থেকে চলনবিলের মাছ কিনতে ব্যাপারিরা এসে হাজির হয়। ট্রাক ভরে মাছ নিয়ে ফিরে।বর্ষাকালে প্রতিদিন এখানে কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। চলনবিলের মাছে অর্থনীতি জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব ফেলে।
চৌগ্রাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা জানান, তাড়াশ, চাটমোহর, গুরুদাসপুর ও সিংড়া উপজেলার কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাট -বাজারে এ অঞ্চলের উৎপাদিত সবজি , মাছ সহ নানা ফসল চাহিদা মিটিয়ে থাকে। যার মুল্য কয়েক কোটির টাকা । অথচ এ সড়কটি না থাকায় বছরের পর বছর এলাকার মানুষ বর্ষা মৌসুমে নৌকায় আর গ্রীষ্ম মৌসুমে পায়ে হেটে মাথায় বোঝা নিয়ে এ সকল হাট বাজারে
সিংড়া পৌর মেয়র মো: জান্নাতুল ফেরদৌস জানান , শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্যানেলটি পুনঃউদ্ধার করে ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে। পৌর এলাকার সড়ক গুলোতে লাগানো হেেয়ছে সৌর বিদ্যুতায়িত সড়ক বাতি। নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের নিংগইন থেকে বালুয়া বাসুয়া মোড় পর্যন্ত লাগানো হয়েছে সড়কবাতি যা এলাকার মানুষদের নজর কেড়েছে। পৌর শেখ রাসেল আউটসোর্সিং সেন্টার ও দর্জি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে বর্তমানে ইউজিআইআইপি প্রকল্পের আওতায় ২৬টি রাস্তা ও ৯টি ড্রেণ নির্মান চলমান আছে। সেই সাথে শহর রক্ষা বাঁধ,পৌর শিশুপার্ক,পৌর মার্কেট,দমদমা মিনি স্টেডিয়াম সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।পৌরসভার কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করায় হয়রানি কমে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে নাগরিক সুবিধা বেড়েছে। পৌরবাসীর জানমালের নিরাপত্তায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি স্থানে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। লাগানো হয়েছে ডিজিটাল ঘড়ি।নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পৌর শহরের বাজার এলাকায় আত্রাই নদী সংলগ্ন ১৭০৮ মিটার শহর প্রতিরক্ষা বাঁধে র নিমার্ণ কাজ শেষ হয়েছে। চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে চলনবিলে শেরকোল এলাকার একই স্থানে ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাইটেক পার্ক, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবায়িত হলে এ এলাকার ২০ হাজার বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হবে।
শেরকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফর হাবিব রুবেল জানান,পাকা রাস্তা না থাকার কারনে দুর্ভোগ ছিলো নিত্যদিনের। এখন আর দুর্ভোগ নাই। মানুষ সহজে যানবাহনে যাতায়াত করতে পারছে। জানা যায়, নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক থেকে কুশাবাড়ি বাজার, ধূলিয়াডাঙ্গা হাট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তার কাজ স¤প্রতি সমাপ্ত হয়েছে। মোট ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কার্পেটিং, দু’ধারে ৩০৬ মিটার প্যলাসাইটং, প্রোটেকশন ওয়াল নির্মান করা হয়েছে।মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। পণ্য বাজারজাত করতে বেগ পেতে হচ্ছে না কৃষকদের।উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা সহজে শহরে যেতে পারছে।
জানা যায়,একসময় সিংড়া উপজেলার মানুষজন চিকিৎসা সেবার জন্য নাটোর সদর হাসপাতাল ও অন্যান্য জেলায় যেতে হতো। একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে এতোদূর পর্যন্ত যাওয়াটা অনেক কষ্টের ছিলো কিন্তু বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ তলা বিশিষ্ট ৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ হয়েছে । পজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী সেবা প্রদানের জন্য ২৫ লাখ ও ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নতমানের দুটি এ্যাম্বুলেন্স প্রদান করা হয়েছে। সিংড়ায় ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা ।৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলার ৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিক সংস্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি ক্লিনিককে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আনা হয়েছে এবং বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। হাসপাতালে এক্স-রে, ইসিজি, আলট্রাসোনো মেশিন প্রদান এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সেবায় হাসপাতালে জেনারেটর প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ফায়ার ষ্টেশন স্থাপন । গত ১০ বছরে সিংড়া উপজেলায় ৮৫ হাজার নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে। ২০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও সিংড়ায় বাসস্ট্যান্ডে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ৫৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, ৬৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু ও হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, তিনতলা বিশিষ্ট ৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ ও তিনটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে। চলনবিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য ১০৪ কিলোমিটার খাল খনন ও শতাধিক ব্রিজ এবং কার্লভাট নির্মাণ করা হয়েছে। ১০০টির অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ, চারতলা বিশিষ্ট উপজেলা প্রশাসনিক ভবন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি বলেন,বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এই জনপদের মানুষ ছিলো চরম অবহেলিত। জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গিকারকে তৃনমূল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি। রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলার উন্নয়ন করার মাধ্যমে শেখ হাসিনার উন্নয়নের রোল মডেলে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আশা রাখি যে সব প্রকল্প চলমান রয়েছে সেই সব প্রকল্প শেষ হলে এই অবহেলিত জনপদের মানুষের ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘুরে যাবে।রাণীনগর উপজেলা প্রকৌশলী সাইদুর রহমান মিঞা বলেন, বর্তমান সরকারের নির্দেশ মোতাবেক দেশের গ্রামীণ জনপদের মেঠোপথকে আধুনিক মানসম্মত পাঁকা সড়কে পরিণত করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর।