চলনবিলকে বলা হয় বোরো ধানের গোলা। বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে
নিমজ্জিত চলনবিলে আবাদী জমিগুলো প্রায়ই এক ফসলী। সেচনির্ভর চাষ
পদ্ধতির বোরো ধানের আবাদই এখানে মৌসুমের প্রধান ও একমাত্র ফসল। এই
বোরো ধান চলনবিল অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ করেছে।
শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত নাটোরের সিংড়া উপজেলায় এই বোরো ধানের
আবাদ ছাড়িয়ে গেছে পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোকে। গত পাঁচ বছরে নাটোর
জেলায় উৎপাদিত মোট বোরো ধানের ৬৩ শতাংশ আবাদ হয়েছে সিংড়ায়
বিলগুলোতে।
সিংড়া ছাড়াও নলডাঙ্গার হালতিবিল, চলনবিল অধ্যুষিত বড়াইগ্রাম ও
গুরুদাসপুর, লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলাতেও উৎপাদিত হয় বোরো ধান। এর
মধ্যে সিংড়ার পর অবস্থান যথাক্রমে নলডাঙ্গার হালতিবিল, গুরুদাসপুর ও
বড়াইগ্রামের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম
হেলাল উদ্দীন জানান, চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে
বোরো আবাদের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ই জানুয়ারী)
পর্যন্ত ৫২ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ স¤পন্ন হয়েছে।
জানা যায়, গত ৫ বছরে জেলায় লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে বোরোর আবাদ
হয়েছে। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৫৭ হাজার ৩৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্য
স্থির করা হলেও ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ২ লাখ ২২
হাজার ৮৮৯ মেট্রিক টন হলেও প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ৬৪
হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন। একইভাবে ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৫৬ হাজার ৪১৫ হেক্টর
জমিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৫৬ হাজার ২৮৩
হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৫৮ হাজার ০৪৪ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৬১
হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮৮ হাজার ০০৬ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯
মৌসুমে ৬১ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন
বোরো ধানের আবাদ হয়।
২০১৪-১৫ আবাদ মৌসুম থেকে ২০১৮-১৯ আবাদ মৌসুম পর্যন্ত জেলায় ১৩
লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শুধু
সিংড়াতেই উৎপাদিত হয়েছে ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪৮ মেট্রিক টন। এছাড়া,
নলডাঙ্গায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুরে ১লাখ ১৫ হাজার ৪৩৮
মেট্রিক টন, বড়াইগ্রামে ১ লাখ ১ হাজার ২১৭ মেট্রিক টন, লালপুরে ২০
হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন এবং বাগাতিপাড়ায় ১৭ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন।
এদিকে, জেলায় বোরো ধানের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক হলেও উদ্বৃত্ত ধান নিয়ে
বরাবরই বিপাকে পড়েন কৃষকরা। প্রতি মৌসুমে জেলার ৭ উপজেলায় গড়ে ২৭
হাজার ১৪২ মেট্রিক টন করে বোরো ধান উৎপাদিত হলেও সমগ্র জেলায়
সরকারীভাবে সংগৃহীত ধানের পরিমাণ মাত্র ২ হাজার মেট্রিক টন। আবার
সরকারের খাদ্য বিভাগের নিকট ধান বিক্রিতেও শক্তিশালী সিন্ডিকেট কবলে
পড়তে হয় চাষীদের। সে হিসেবে উৎপাদতি বোরোর সিংহভাগই উদ্বৃত্ত
হিসেবে থেকে যায়। স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারী ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ালে
উদ্বৃত্ত ধানের নায্যমূল্য প্রাপ্তির মাধ্যমে কৃষকের বিক্রি নিশ্চিত হবে।
সিংড়ার চৌগ্রামের কৃষক সালাউদ্দীন আহমেদ বলেন, বছরে বোরো
আবাদকালীন সময়ে চলনবিল এলাকায় অকাল বন্যা হয়। এত ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই
তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক না থাকলে এ অঞ্চলে বোরো
ধানের আবাদ আরো বাড়তো।
ইটালী ইউনিয়নের বিল তাজপুর গ্রামের কৃষক রিপন আলী বলেন, নানা
প্রতিকূলতা সত্বেও সিংড়ায় বোরোর আবাদই জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
চাষীরা বোরো আবাদে যেসব ঝুঁকি নেয়, সে অনুযায়ী ধানের দাম পায় না।
সরকার ধানের ক্রয় বাড়ালে কৃষক কিছুটা হলেও লাভবান হবে।
নলডাঙ্গার হালতি বিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মাসুদুর রহমান বলেন,
এখানে বোরো আবাদ বেশী হওয়ায় অনান্য জেলাগুলো থেকে সংগ্রহ কমিয়ে
এখান থেকে সরকার ক্রয় করতে পারে। আসন্ন মৌসুমগুলোতে সরকার এমন
পদক্ষেপ নিলে কৃষক লাভবান হবে।
জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, সিংড়ার মতো
এক ফসলী এলাকায় বোরো ধানের আবাদ বেশি হলেও সরকার বোরো রেখে বেশি
পরিমাণে আমন ধান সংগ্রহ করে। এটি সরাসরি কৃষকদের সাথে তামাশা।
বোরো ধানে চলনবিল স্বয়ংস¤পূর্ণ হলেও দাম না পেয়ে বারবারই কৃষক
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক ফসলী আবাদ এলাকাগুলোতে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া
উচিত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বলেন,
নাটোর থেকে বোরো ধান সংগ্রহ বাড়াতে প্রতিবারই আমরা খাদ্য বিভাগের
কাছে প্রস্তাব রাখি। জেলা ভিত্তিক উৎপাদন অনুপাতের নিরীখে চুড়ান্ত
চাহিদা দেয় খাদ্য বিভাগ। আশার কথা হলো, চলতি মৌসুমে যেভাবে জেলা
থেকে আমন আবাদের লক্ষমাত্রা অর্জিত হওয়ায় অতিরিক্ত ৭০০ মেট্রিক টন ক্রয়ের
চাহিদা এসেছে সেভাবে আগামীতে বোরোর লক্ষমাত্রা অর্জন সাপেক্ষে উদ্বৃত্ত
ধান সরবরাহের সুপারিশ করা হবে।