একুশ ফেব্র“য়ারি মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি বাঙালির জাতীয় জীবনের
মাহেন্দ্রক্ষণ। এমন এক অর্জন জুটিয়েছে দিনটি যা কোনদিন ¤-ান হবে না। বিভিন্ন অর্জনই জাতিকে,
দেশকে, মানুষকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করায়। একুশ ফেব্র“য়ারি এমন এক অর্জন এনেছে আমাদের জীবনে
যা অন্য সব অর্জনকে অনেকটাই ছাড়িয়েছে। এ অর্জনের বিশালত্বের কারণেই হয়তো। আর তা নির্মুলের
প্রয়াসকৃত সময়ের ব্যাপকতাও নয়। দু’ থেকে তিনশ বছর এর মেয়াদ কাল। ইংরেজি, উর্দু, আরবী, ফারসী কত
ভাষার কত শব্দ শুভাগমন করেছে বঙ্গ ভাষার ক্রোড়ে। এতোটুকুই ছিল শুধু পাওয়া। দেয়া-নেয়াই যদি হয় সমৃদ্ধির
উপায়, তাহলে আমরা এবং আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সর্ব প্রকারে এভাবেই ঋদ্ধ। সীমাবদ্ধতায়
সংকীর্ণতারই জন্ম হয়। দেশটি আমাদের ছোট, আয়তনে স্বল্প কিন্তু কপালগুণে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান দখলকারী।
নিঃসন্দেহে তা প্রমাণিতও।
ঊনিশ’শ আটচলি-শ সনে আমরা পাকিস্তানী শাসনে ছিলাম। যাঁরা আমাদের মাতৃ ভাষাকে, এদেশকে চির
বনবাসে পাঠিয়ে, তাদের উর্দু ভাষাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আর ঐ সময়েই এ অঞ্চলের পার্লামেন্টে বলিষ্ঠ
কণ্ঠে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নামে বাঙালি বীর, দেশ প্রেমিক সৈনিক বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দানের কথা
বলেন। কুম্ভকর্ণের ঘুমের অবসান তখনই হয়েছিল মনে হয়। বায়ান্ন সালে সরাসরি রক্তদান এ ভাষার জন্যে।
চেতনার আঘাতে চৈতন্য জাগরিত হতে থাকে এ সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী
তাদের যে কত বড় অবদান এ মায়ের ভাষাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে, তা অবর্ণনীয়।
বায়ান্নয় আমার জন্মই হয়নি। কিন্তু যখন এ বিষয় নিয়ে ভাবি, লেখালিখি করি, তখন মনে হয় যেন এগুলো
প্রত্যক্ষ করেছি। আমার এক আদর্শ মহাপুরুষ ছিলেন তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, বাঙালি জাতির এ
করুণ পরিণতি। আর যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামিও না।”
এর আলোকেই অদম্য কিছু মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য, ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল।
আর আমরা এতো গুলো মানুষ সোনার ফসল ভোগ করছি এখন। কিছু প্রাণই ক্ষণজন্মা হয়। সালাম, বরকত,
রফিক, জব্বার এর মধ্যে অন্যতম। এ মস্ত—কগুলোই উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমস্ত দেশের বিভিন্ন
স্থানে মিনার হয়ে।
একুশ ফেব্র“য়ারি প্রতি বছর ঘটা করে পালিত হয়। আর একটি মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করলে হয়তো
দিবসটিকে আরো মর্যাদা দানে ভূষিত করা যাবে। সেটি হলো, দিবসটি ‘রক্তদান দিবস’ হিসেবে
ঘোষণা করা। আর্ত রোগীদের সেবার উদ্দেশ্যে সহৃদয় ব্যক্তিরা রক্তদান করবে। রক্তের ঋণ রক্ত দিয়ে পরিশোধের চিন্তা
উত্তম। একুশ ফেব্র“য়ারিতে মাতৃভাষা রক্ষার্থে প্রাণ দিয়েছিল গুটি কয়েক যুবক। আমরাও তো কিছু
কিছু মানুষ রক্ত দান করে হাজার-হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারি।
অন্যকে রক্ষা করা, সহায়তা করাই ধর্ম। তাই ভাষার জন্য জীবন দানকারী শহীদেরা বড় ধার্মিক। তাদের সাধনার
সব ধন আমাদের হৃদয়পটে রক্ষিত।
যে হৃদয় উজাড় করে আমরা মনের সুখে গেয়ে যাই, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি আমি কি
ভুলিতে পারি/ প্রখ্যাত সাংবাদিক, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সাহিত্যিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী আমাদেরকে যে
সঙ্গীতটি উপহার দিয়েছেন, তা মাতৃষাষা ও শহীদদের প্রতি চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ
মাধ্যম। সঙ্গীতটির সুরেও যে গাম্ভীর্যতা তা পাষাণকেও বিগলিত করে। একুশ ফেব্র“য়ারি, আব্দুল গাফফার
চৌধুরী, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার যেন এক সূত্রে গাথা। কত মমতায় নিবেদিত এ প্রাণগুলো। আমাদের
চৈত্যন্যের জাগরণ ঘটায় এ প্রাণগুলো।
একুশ ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘একুশে বইমেলা।’ কত সৃজনশীল মানুষের সমাগম
হয় সেখানে। সকল পন্ডিতের মেলা জমে। গত বছর সে মেলায় গিয়েছিলাম। প্রতিটি বুক স্টল ঘুরে ঘুরে
দেখেছি। প্রতিটি বইকে মনে হয়েছে যেন মানসিক আরোগ্য নিকেতন। মানসিক বিষাদে দেহে রোগের
সৃষ্টি হয়। মানসিক প্রশান্তি আরোগ্য দান করে। বইগুলো সেই বস্তু। যা মনকে আনন্দ আপ-ুত করে সর্বদা।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পড়ার মত যত কিছুই ইন্টারনেটের মাধ্যম আমাদের চোখে ভেসে উঠুক না কেন
বাস্তবে একটি বই যখন হাতে উঠে তখন এর আনন্দের আর বিকল্প হয় না। বিখ্যাত সেই উক্তি, ‘‘রুটি মদ
ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা।” এ যৌবনের
রূপরেখাই আমাদের এ বই মেলা এবং এ দিনটি। আমাদের ধ্যানে, জ্ঞানে, চিন্তা-চেতনায় সদা জাগ্রত
থাকুক এ সম্পদ।
প্রত্যেকের একটি জীবনী শক্তি থাকে, আর সেটিকে বলে ‘প্রাণ’। মাতৃভাষা হলো সে প্রাণ। এ প্রাণকেই
গ্রাস করতে চেয়েছিল কিছু বিদেশি হায়েনা। পারেনি, কপালগুলে বেঁচে যায় সে। ওদের কত ফিকির-
ফন্দিকে মোকাবেলা করতে হয়েছে বাঙালি জাতির সে হিসেব মেলা ভার। জগত সৃষ্টির পর থেকে দুটো ধারা
চলে আসছে। একটি অত্যাচার আর একটি শান্তিবারি। তবে কালে কালে প্রমাণিত হয়েছে অত্যাচারীই
শেষাবধি নিগৃহীত হয়েছে সত্য সুন্দরের কাছে।
একুশ ফেব্র“য়ারি সত্য ও সুন্দরের ন্যায় আমাদের নিকট প্রতিভাত। নির্জীবের মধ্যে সজীবতা, নি®প্রাণের
মধ্যে প্রাণের স্পন্দন, মৃতের মধ্যে অমৃতের সন্ধান এ ফেব্র“য়ারি। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি দীর্ঘ দিন
ধরে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর উদ্বোধনে, আমাকে জাতীয় সঙ্গীত পরিচালনায় আমার সোনার বাংলা গান গেয়ে
শুরু করতে হয়। আরেক ক্ষণজন্মা পুরুষের লিখা গানটি গাওয়ার সময় মনে হয় যেন চোখে জল আসে। দেশ প্রেমের
আকুল বন্যায় ভাসতে ইচ্ছে করে তখন। একুশ ফেব্র“য়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদেরকে অমূল্য
সম্পদ এনে দিয়েছে। নব জীবন দানকারী এ দিবসগুলো প্রতি বছর ফিরে আসুক আমাদের বাঙালি জীবনে;
তাহলেই সার্থকতায় পূর্ণ হবে বিক্ষত এ বঙ্গ জননী।