নজরুল ইসলাম তোফা:: বাংলা ভাষা বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা। এই মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে বাঙালি জাতি। তাইতো ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চেতনার দিন, নবজাগরণের দিন। কবিরাও বলেছে, ‘মায়ের ভাষা, সেরা ভাষা খোদার সেরা দান।’ মাতৃভাষা বা ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’’ এমন গান শুনলেই মনে হয় আমরা ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে ফিরে যাই। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এমন গান চির অম্লান হয়ে রবে। প্রত্যেক জাতির জীবনে বিরল কিছু স্মরণীয় দিন থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে- ‘রেড লেটার ডে’। সুতরাং একুশের ফেব্রুয়ারি দিনটা অনন্য স্বতন্ত্রতায় ইতিহাসের পাতায় পাতায় কালজয়ী সাক্ষী হয়েই থাকবে। এই দেশের সকল চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সুরকার এবং গীতিকাররা একুশকে ধারণ করেছিল তাদের লেখায়, সুরে, কণ্ঠে আর শিল্পীর তুলিতে। আর সেসব গান, কবিতা বা শিল্পকর্ম আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। একুশকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়।
১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির সময় একজন ভাষা সৈনিক:- মাহবুব উল আলম চৌধুরী একুশের কবিতা লিখে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বলা যায় তিনিই অমর একুশের প্রথম কবিতার জনক। এই দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলে ছিল, ”আমি মুগ্ধ আমি প্রীত, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের কথা আমার ভাষায় জানাতে পারব বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে। সত্যিই গর্বিত আমি।’’ তাই তো ভাষা আন্দোলন জাতি গোষ্ঠীর সর্ব বৃৃৃহৎ চেতনার ইতিহাস। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই রাজপথ রঞ্জিত করা ইতিহাস। এখন বাংলাদের বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত। একুশ এখন সমগ্র বিশ্বের। কিন্তু কেমন ছিল একুশের প্রথম প্রহর বা একুশের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রথম সেই বারুদের সংযোজন। আর তখনকার সেই বিদ্রোহের অনুষঙ্গটাই বা কি ছিল? তা ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনার চেষ্টা করা মাত্র। সেই দিনের প্রথম কিছু বা প্রথম সৃষ্টি কিংবা তার অবদানকে নিয়েই লেখা। আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে পারে এই লেখাটি বিশ্লেষণ করে। আসলেই এ আলোচনায় অনেক দিকই চলে আসেতে পারে, সব কিছু তো তুলে ধরা সম্ভব হবে না। তবুও মৌলিক কিছু কথা না বললেই নয়।
এই ভাষার সঙ্গেই যেন সংশ্লিষ্ট জীবনবোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য, জাতির আধ্মাতিক সত্তা সংরক্ষণের সংগ্রামের মূর্ত রূপ ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাই এমন দিনের গুরুত্বটা অবশ্যই হৃদয়গ্রাহী। প্রথমে এই ভাষার জন্যে এদেশের ছাত্ররাই যেন আন্দোলন চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ছিল। ফলে সেই সময়র ছাত্রদের মনোবল অনেক বেড়ে যায় এবং তারা সামনের দিকে দৃঢ় মনোবলে এগোতে শুরু করে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে সেই ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলও করে ছিল। পুলিশ মিছিলের উপর গুলী চালায়। এতে অনেকে নিহত হয়েছিল, আজ তাদেরকেই শহীদ বলা হয়। এ হত্যাযজ্ঞের জন্য ছাত্র সমাজসহ সকল শ্রেণীর মানুষেরা ভাষার আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। ভাষার জন্যেই যেন আন্দোলনের প্রথম লিফলেট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। লিফলেটটির আকার ছিল প্লেট অনুযায়ী ১/১৬। গুলি বর্ষণের অল্প কিছুক্ষণ পর পরই হাসান হাফিজুর রহমান, আমীর আলী সহ অনেকেই যেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যান। সেখানে গিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন। দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই ‘মন্ত্রী মফিজউদ্দীনের আদেশে গুলি’ শীর্ষক লিফলেটটি ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। প্রায় দুই/তিন হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এমন লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ছিল। বলা যায় যে, চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ঐদিনই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই স্মৃতি মতো অনেক স্মৃতিই যেন আমাদের ভাষা আন্দোলনকে অমর ও অক্ষয় করে রেখেছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হত্যাকান্ডের খবর সারা দেশেই পৌঁছে যায়। অতঃপর পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মাঝে যে চেতনার উন্মেষ হয়, তার চরম বিস্ফোরণ ঘটে ছিল ঊনসত্তর থেকেই একাত্তরে।বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের মূল চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই বাঙালি উপলব্ধি করেছিল তার বাঙালি জাতীয়তাবোধ, তার সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী। এমন এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন এই দু’ধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তি সংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্ব পূর্ণ দিন। একুশের চেতনাই যেন বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায় ও অবিচার, অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধেই আপোষহীন সংগ্রামের প্রেরণা।একুশের প্রথম নাটক ‘কবর’, তা মুনীর চৌধুরী রচনা করেছিল। এমন এই ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধেই যেন ’৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন মুনীর চৌধুরী সহ রণেশ দাশগুপ্ত। তাদের পাশাাপাশি অনেক লেখক বা সাংবাদিকরাও জেলে আটক হয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিল। রণেশ দাশ গুপ্ত জেলের এক সেলে আটক, আর অন্য একটি সেলেই মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে চিরকুট পাঠান। সে চিরকুটের লেখাটি ছিল- শহীদ দিবসে রাজবন্দিরাই নাটকটি মঞ্চায়ন করবেন, জেলে মঞ্চসজ্জা ও আলোর ব্যবস্থা করা যাবে না। এমন কথাগুলো কৌশলে মুনীর চৌধুরীকে বলা হয়, নাটকটি এমনভাবে লিখতে হবে, যাতে খুব সহজে কারাগারেই এটি অভিনয় করা যায়। মুনীর চৌধুরী ’৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি, রাত- ১০টায় কারাকক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর শুধুমাত্র হ্যারিকেনের আলো-আঁধারিতেই কবর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। অভিনয়ে অংশ নেন বন্দি নলিনী দাস, অজয় রায় প্রমুখ।
ভাষার আন্দোলনটি জাতীয়তাবাদেরই প্রথম উন্মেষ। আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল ছিল বাঙালি জাতির আপন সত্তার উপলব্ধি এবং ঐক্যবদ্ধ হওবার প্রেরণা। এমন আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। এমন আন্দোলনে প্রথম ছাপচিত্র অঙ্কন করেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, বায়ান্নর ভাষাকর্মী- মুর্তজা বশীর। ছাপচিত্রটির শিরোনাম হলো ‘রক্তাক্ত একুশে’। মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন। শহীদ বরকতের রক্তে তার সাদা রুমাল রঞ্জিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আঁকা তাঁর এমন ছাপচিত্রটিতে তিনি একুশের ঘটনা অঙ্কিত করেছিল। একজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতাকে একেঁছেন সেখানেই ফুটে উঠে- মিছিলে গুলি বর্ষণের ফলে পড়ে যান, তার স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ডটি পড়ে যায় এবং তার হাতে থাকা বইটিও মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। অমর একুশে আজও বাংলাদেশে শহীদ স্মরণে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেই যেন মাতৃভাষার জন্যে বিভিন্ন শহীদ ও বুদ্ধিজীবীদেরকে স্মরণ করা হয়। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য বিশ্লেষণে শুধু শহীদ দিবস কিংবা গ্রন্থমেলা পালনেই সরকার সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাকে এই বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তারেও আগ্রহী ভূমিকা পালন করছে। একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্ণ ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এমন এ ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই। কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। এই দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজজীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেছিল। দেশের স্বাধীনচেতা মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণরা সেই উর্বর ক্ষেত্রেই রক্তবীজ বপন করেছিল। ফলেই আজকের এই সোনালি ফসল। এই তরুণদের সংগ্রামী চেতনা সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং গড়ে তোলে এক অজেয় শক্তি। তাই তো পরবর্তী সময়েই রাজনীতিতে প্রদান করে নতুন দ্যোতনা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই যেন সৃষ্টি হয় এক নতুন শক্তি। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওই সব শহীদ এবং বীর যোদ্ধাদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করতে পেরেছি। এমন দিনের সৃষ্টিতে তরুণরা রক্তাক্ত অবদান রাখলেও এখন তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে শাসক চক্র বাঙালী জাতিকে দুর্বল করতেই বাংলার মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষার উপর চক্রান্ত শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের শুরুতে মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ প্রাণের দাবীতে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র যুব সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল করে। এ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অনেকেই যেন সেই দিন শহিদ হয়েছিল। আর বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপায় না দেখে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই বাধ্য হয়ে ছিল। একটু ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে পরিস্কার ভাবে জানা যাবে, তা হলো পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এর তৎকালীন উপাচার্য- ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল। আর পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এইভাবেই যেন ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেছিল উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর ফলেই তুমুল প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর পরই এদেশের ভাষা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বাঙালিদের মাতৃভাষার উপর চরম আঘাত হানে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই যেন রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন শুরু হলেও ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নেই বাঙালি জাতি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়। কেউ কবিতা লিখে, কেউ গান বা নাটক লিখে, কেউ বা চলচ্চিত্র কিংবা চিত্রাঙ্কন করে। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বটা যে, এ সবের মাধ্যমেই এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী শিক্ষা নিয়ে থাকে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই যেন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকচক্রের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়ে ছিল। জানা প্রয়োজন তা হলো, একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ছিল তৎকালীন ‘দিলরুবা’ পত্রিকার প্রকাশক এবং এতে স্কেচ আঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। সেই গুলোকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাগজে ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজ গুলো বিলি করে ছিল। সেই দিন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে কারফিউ ছিল বলে ৬ টার আগেই হাতে হাতে কাগজ বিলি করা হয়ে যায়। তাইতো ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রেরণা দিয়েছিল একুশ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের রক্ত রাঙ্গা ইতিহাস। বলা যায় যে, সর্ববস্তরে মানুষ ও ছাত্র সমাজের তীক্ষ্ম মেধা দ্বারাই মাতৃভাষার জন্যে সংগ্রাম করেছিল। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এখন আমাদের কর্তব্য বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানো।
ভাষার জন্য জীবন দান এ বিরল আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সম্পূর্ণ ভাবে ঘোষণা করে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিনটিকে প্রতি বছর পালন করে আসছে। জাতিসংঘে এর আগেও ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতি সংঘের সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক ভাবেই এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ৩০ তম অধিবেশনে এক পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবটির খসড়াও পেশ করেছিল। বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় ২৭টি দেশ। দেশ গুলো হলো:- সৌদি আরব, ওমান, বেনিন, শ্রীলঙ্কা, মিশর, রাশিয়া, বাহামা, ডেমিনিকান প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ, ফিলিপাইন, কোতে দি আইভরি, ভারত, হুন্ডুরাস, গাম্বিয়া, মাইক্রোনেশিয় ফেডারেশন, ভানুয়াতু, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, কমোরো দ্বিপপুঞ্জ, পাকিস্তান, ইরান, লিথুনিয়া, ইতালি, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া ও প্যারাগুয়ে। ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই যেন বাংলা ভাষা সহ বিশ্বের চার হাজার ভাষাও সম্মানিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির মাঝে নবচেতনার জন্ম হয়। তা হচ্ছে স্বাধীকারের স্বপ্ন। এর পথ ধরেই যেন আসে বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং বিস্তারে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করা যায়। আর মাতৃভাষার প্রতি অবশ্যই এই দেশের শ্রদ্ধাবোধ বাড়াবে। আজও তাই বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্য এবং সংস্কৃতি একুশের চেতনায় যেন বিকশিত হচ্ছে। আজও তা অব্যাহত রবে নব নব রূপেই জাতির হৃদয়ে সাড়া দিবে। বাংলা ভাষার জন্যেই সেই সময় একুশের প্রথম গান রচনা করে বাঙালি জাতি হৃদয়কে পুলকিত করেছিল। ভাষাসৈনিক আ.ন.ম. গাজীউল হকের প্রথম গানটির প্রথম লাইন: ‘‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না”। এমন ভাষা-আন্দোলনের সুচনার গান হিসেবে এটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং আন্দোলনের মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। গানটির সুর দেয়া হয়েছিল হিন্দি গান ‘দূর হাটো, দূর হাটো, ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’ এর অনুকরণে। একুশের হত্যাকাণ্ডের পরপরই গাজীউল হকের এ গানটি ছিল ভাষাকর্মীদের প্রেরণার মন্ত্র। শুধুমাত্র রাজপথের আন্দোলনে নয়, জেলখানায় রাজবন্দিদের দুঃখ কষ্ট নিবারণে এবং তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে এই গান ছিল প্রধান হাতিয়ার। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকীতে আরমানিটোলার ময়দানে আয়োজিত জনসভায় গানটি ১ম গাওয়া হয়। ভাষার জন্য সেসময় কারো অবদান কম ছিলনা। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যেন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়ছিল।প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির একটি অংশে প্রভাতফেরি ও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্য রয়েছে। খালি পায়ে ফুল দিতে যাওয়ার সেই দৃশ্যে বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এমন গানটি সম্পূর্ণ বাজানো হয় আবহসঙ্গীত হিসেবে। পরিশেষে বলতে চাই যে, বিশ্বের কোন দেশে কিন্তুু মাতৃভাষার জন্য এই ভাবে আন্দোলন হয়নি। সেদিক দিয়ে বাংলাভাষার একটি বিশেষ স্থান বিশ্বে আছে। যা‘সবার উর্ধ্বে। তাই আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব কমিয়ে সরকারকে নিজ দেশের চ্যানেলগুলোর প্রতি সবাইকে বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলা সহ প্রত্যেক বছর বই মেলা বৃহৎ আকারে আয়োজন করেই- আমাদের বাংলাভাষা কিংবা মাতৃভাষাকে খুব শক্তিশালী করতে হবে। তাহলেই হয়তো একুশে ফেব্রুয়ারী “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস“ বা দেশীয় একুশের বিভিন্ন উৎসব পালন করাটাও সার্থক হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক। সুতরাং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেই একমত পোষণ করে বলাই যায়,-“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। সার্থক জনম, মাগো, তোমায় ভালোবেসে”॥
লেখক:- নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।