মৌসুমী রিতু নামে এক তরুণীর উদ্যোগে তার কয়েকজন সহপাঠিদের নিয়ে শত প্রতিকুলতা পেরিয়ে হাটি হাটি পা পা করে আজ ১৮০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মাঝে বিনামুল্যে আলো ছড়াচ্ছে এই বিদ্যানীড় স্কুলটি। বিদ্যালয়টি বর্তমানে একটি অস্থায়ী কাঠামো পেলেও এর শুরুটা হয়েছিল একেবারেই খোলা আকাশের নিচে। বর্তমানে বিত্তশালী ব্যক্তি কিংবা সরকারের কাছে একটি স্থায়ী কাঠামোসহ শিশুদের পড়া শুনার স্বীকৃতি হিসাবে রেজিঃ বিদ্যালয়ে অর্ন্তভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকসহ প্রতিষ্ঠাতা মৌসুমী।
কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের সামনে নরসুন্দার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই চোখে পড়বে কিছু তরুণ-তরুণী মেঝেতে চট বিছিয়ে পড়াচ্ছেন একদল শিশুকে। তাদের চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণির বই-খাতার ছড়াছড়ি। এই শিশুদের কেউ কাজ করে ফুচকার দোকানে, কেউ হোটেলে, আবার কেউ করে চা-পিঠা বিক্রি। চারপাশে খোলা এই স্কুলটির কাছে যেতেই কানে আসে শিশুদের কোলাহল। এই শিশুদের অনেকের বাবা বেঁচে নেই, অনেকের মা বেঁচে নেই। কারো মা মেসে রান্না করেন। আবার কারো মা হোটেলে কাজ করেন। কেউ ফেরি করে তৈজসপত্র বিক্রি করেন। তাদের অনেকের বাবা একেবারেই হতদরিদ্র। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করার চিন্ত াও কোনদিন করতেন না ওইসব শিশুদের বাবা-মায়েরা।
মৌসুমী রিতু নামে এক তরুণীর উদ্যোগ আর ভালবাসায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি আলো ছড়াচ্ছে। এখানে এখন পাঠ নিচ্ছে ১৮০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু। অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত এই শিশুদের নিয়ে। নতুন ব্যাগ, বই-খাতা, কলম, পেন্সিল যাবতীয় সব কিছুই শিশুদের দেয়া হচ্ছে। আদর-স্নেহ আর পরম মমতায় পড়ানো হচ্ছে তাদের। শিক্ষার্থীরাও পড়াশুনা করছে আনন্দ আর মনোযোগে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা এবং বিকাল ৩টা থেকে ৫টা দুই ব্যাচে পড়ানো হয় শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীদের।
তিন বছর আগের শুরুর সেই গল্প বলছিলেন ‘বিদ্যানীড়’ এর প্রতিষ্ঠাতা মৌসুমী আক্তার রিতু। রিতু তখন গুরুদয়াল সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজের সামনের মাঠে হাঁটতে গিয়ে দেখেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কেউ মানুষের কাছে হাত পাতছে, আবার কেউ অস্থায়ী ফুচকা-ঝালমুড়ির দোকানে শ্রম দিচ্ছে, কেউবা ক্ষুধার্ত চোখে অন্যের খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। রিতুর ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার ভাবনায় ঠাঁই নেয় সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু; তাদের সুন্দর একটি আগামী। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর গুরুদয়াল কলেজ মাঠে খাদিজা নামের একটি শিশুকে নিয়ে সবুজ ঘাসে বসে পড়েন রিতু। পড়ানো শুরু করেন কোন ধরনের আয়োজন ছাড়াই। দু-তিন দিনের মধ্যে আরো কয়েকটি শিশু রিতুর খোলা মাঠের পাঠশালায় যোগ দেয়। রিতুর পাশে দাঁড়ায় সহপাঠী বান্ধবী সাকিলা ইশরাত। দুই বান্ধবী রিতু আর সাকিলা নেমে পড়েন শিক্ষার্থী সংগ্রহের কাজে। শহরের হারুয়া এলাকার সজিব বেকারির গলিতে শিক্ষার্থী সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে মুখোমুখি হন নিদারুন বাস্তবতার। বিনা খরচে শিশুদের পড়াবার কথা শুনেই ছেলেধরা সন্দেহে তাদেরকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন অভিভাবকরা। ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, টিপ্পনিও কাটেন অনেকে। কিন্তু কোন কিছুতে দমে যাননি দুই তরুণী। বৃষ্টি নামের একটি শিশুকে দিয়ে সজিব বেকারির গলির এক চিলতে জায়গায় বিদ্যানীড় সাজান রিতু-সাকিলা। একে একে ১৭টি শিশু ভরিয়ে দেয় বিদ্যানীড়কে। দুই তরুণী স্বেচ্ছাশ্রমে শিশুদের পড়িয়ে গেলেও সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর বই-খাতা আর প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা।
ফেসবুকে এ ব্যাপারে পোস্ট দিল এগিয়ে আসেন তন্ময় শেখ রাজ নামের এক তরুণ। দুই মাসের মধ্যে বিদ্যানীড়ে নাম লেখায় ৬৫ জন শিশু। এত বিপুল সংখ্যক শিশুকে পাঠদান নিয়ে বিপাকে পড়েন রিতু। বিদ্যানীড়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যার বিষয়টি জেনে এগিয়ে আসেন কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ। তিনি পৌরসভা প্রাঙ্গণে নবনির্মিত নগর মাতৃসদনের নিচতলাটি বিদ্যানীড়ের শিশুদের ব্যবহার করতে দেন। এক পর্যায়ে নগর মাতৃসদনের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হলে আবারও খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয় বিদ্যানীড়ের শিক্ষার্থীদের। তবে সহসাই কালো মেঘ অপসারিত হয়ে হেসে ওঠে আলোকিত রবি। এবার বিদ্যানীড়ের পাশে দাঁড়ান কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুল গণি ঢালী লিমন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে পাগলা মসজিদের সামনে নরসুন্দা পাড়ে বিদ্যানীড়ের শিক্ষার্থীদের জায়গা করে দেন। সেখানেই নির্মাণকাজ চলছে বিদ্যানীড়ের নতুন ঠিকানার।
কোনোরকম প্রত্যাশা ছাড়া কিসের টানে ছুটে সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন? এমন প্রশ্নে মৌসুমী রিতু বললেন, ‘আসলে ভালোবাসা থেকেই ওদের পাশে থাকা। যখন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নানা বঞ্চনার চিত্র দেখতাম, খুব খারাপ লাগতো। যখন দেখতাম ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভিক্ষা করছে। রাস্তার পাশে কারো খাবারের দিকে চেয়ে আছে। ক্ষুধার্ত, কিন্তু খেতে পারছে না। খুব কষ্ট হতো। ২০১৬ সালে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিষয়গুলো খুব ভাবাতো আমাকে। তখনই ওদেরকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছাটা জাগে। মনের তাগিদ আর ভালবাসা থেকে জড়িয়ে যাই তাদের সাথে।’
দীর্ঘ তিন বছর আগে শুরুর সময় থেকে মৌসুমী রিতুর যোগ্য সহযাত্রী হিসেবে এই শিশুদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন সাকিলা ইশরাত। তিনি বলেন, ‘মনের আনন্দ আর ভালোবাসা থেকে তাদের জন্য কাজ করছি। দূর থেকে ছুটে এসে শিশুরা যখন জড়িয়ে ধরে, তখন অন্যরকম লাগে। শুধু পড়াশুনা নয়, শিশুদের বিকাশের জন্য তাদের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডেরও পাঠ দিচ্ছি আমরা। সব মিলিয়ে সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর জন্য কিছু করতে পেরে ভীষণ পুলক বোধ করছি।
’ বিদ্যানীড় স্কুলটির বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, এই স্কুলটি আমার নজরে এসেছে। সরজমিনে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার। মৌসুমীর এই মহতি উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। জেলা প্রশাসক মহোদয় বরাবর যদি আবেদন করে, তবে সহযোগিতা করা যেতে পারে এবং বিদ্যালয় রেজিষ্টার ব্যাপারে বিদ্যানীড় স্কুলটির যথাযথ কাগজ পত্র দাখিল করলে হয়তো বিদ্যালটি রেজিষ্টার অন্তরভুক্ত করা সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমার মনে হয়। আমি মৌসুমী ও তার বিদ্যানীড়ের উত্তরোত্ত্বর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
মৌসুমীর এই মহতি উদ্যোগকে আরো বেগবান ও ফলপ্রসূ করে তুলে সমাজের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মানব সম্পদে পরিনত করতে হলে, সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতার বিকল্প নেই। আসুন আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হই।