প্রতি মৌসুমে নাটোর থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রসুন বিক্রি হয়। সাদা সোনা (শ্বেত স্বর্ন) খ্যাত এই রসুন দেশের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ নাটোরে উৎপাদিত হয়। এই জেলায় প্রথম শুরু হয় বিনা চাষে রসুন উৎপাদন। চলনবিল অধ্যুষিত জেলার গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায় বিনা চাষে রসুন আবাদ বেশী হয়। এছাড়া অন্যান্য ৫ উপজেলায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আবাদ হয় রসুনের। কৃষকের নায্যমূল্য নিশ্চিত হলে পরিকল্পিত উৎপাদনের মাধ্যমে নাটোরের রসুন পাল্টে দিতে পারে আঞ্চলিক মসলাজাতীয় ফসলের ঘাটতিজনিত আমদানীর দৃশ্যপট।কৃষকরা জানান, বন্যার পানি নামার পর বা আমন ধান কাটার পর ভেজা জমিতে বীজ বপন করে খড় ছিটিয়ে রসুনের আবাদ হল বিনা চাষের রসুন। গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলী জমিতে বিনা চাষে রসুন আবাদই জেলায় বৃহদায়তন রসুন উৎপাদনের কারণ। অপরদিকে, বীজ বপনের পর পরিমাণমতো টিএসপি, মিউরেট অব পটাশসহ অনান্য উপাদান প্রয়োগ করে জমি প্রস্ততের মাধ্যমে আবাদ হল স্বাভাবিক আবাদ।
এ পদ্ধতিতে নলডাঙ্গা, সিংড়া, লালপুর, বাগাতিপাড়া ও নাটোর সদরের বেশ কিছু এলাকায় রসুন আবাদ হয়।কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১-১২ মৌসুমে জেলায় ১৫ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ মৌসুমে ১৮ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১১ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ মৌসুমে ১৫ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ মৌসুমে ১৭ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১৮ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ২৫ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ মৌসুমে ২৮ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯৭ মেট্রিক টন এবং ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদিত হয়।
কৃষি পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১২-১৩ মৌসুমে রসুনের চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন কমে যায় । পরের বছর আবাদের পরিমাণ কমলেও উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। পরবর্তী তিন মৌসুমে আবাদের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে রসুনের উৎপাদনও বাড়তে থাকে। ২০১৬-১৭ উৎপাদন মৌসুমে ২ লাখ ১ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদন হয় নাটোরে যা এখন পর্যন্ত জেলার সর্বোচ্চ রসুন উৎপাদন। পরের বছর কৃষক উৎসাহিত হয়ে আবাদের পরিমাণ বাড়ালে কিছুটা কম রসুন উৎপাদিত হয়। হঠাৎ করে গত ২০১৮-১৯ মৌসুমে কৃষক আবাদের পরিমাণ কমিয়ে দিলে উৎপাদন কমে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টনে নেমে আসে।
জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা সাধারণ স¤পাদক আবদুল করিম বলেন, প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ কৃষকদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হলে রসুনের বৃহদায়তন উৎপাদন সম্ভব হবে। আঞ্চলিক উৎপাদনে গুরুত্ব দিলে দেশে রসুনের ঘাটতি থাকবে না।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক এ কে এম হেলাল উদ্দীন জানান, ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে রসুন উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া গত ৮ বছরে জেলায় রসুন উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা ইন্সটিটিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ কামরুল হাসান বলেন, চাষ ও বিনাচাষের রসুনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। বরং উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় চাষের রসুনের সমান দামই পেয়ে লাভবান হয় কৃষক। নিঃসন্দেহে এ অঞ্চল থেকে রসুন উৎপাদন করা হলে আমদানী নির্ভরতা কমে যাবে।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ডীন প্রফেসর মুহাম্মদ মিজানুর রহমান সরকার বলেন, দেশে রসুনের উৎপাদন ঘাটতি মোকাবিলায় নাটোরে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ সহায়তার মাধ্যমে রসুন চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হলে এখান থেকে দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে রসুন রপ্তানীও করা যাবে।