এতিম চারটি ভাই-বোনোর ঠিকানা এখন রাস্তায়। বাবা-মা হারা এই এতিমদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ঘরের মালামালও নিতে দেয়নি প্রভাবশালীরা। এক কাপড়ে ঘর থেকে নামিয়ে দেওয়ায় ৭ টি মাস তারা আছেন অন্যের আশ্রয়ে। পড়ার বই-খাতা নিতে না দেওয়ায় বড় বোন কবিতা এবার বিএসএস শেষ বর্ষের পরীক্ষাটিও দিতে পারেনি। সারাক্ষণ চোখের কোনায় পানি নিয়ে ঘুরছে ভুমিহীন, বাড়িছাড়া এই এতিম চারটি ভাই-বোন। অসহায় পরিবারটি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের।
বড় বোন কবিতা খাতুন (২৩) জানান, তারা ক্রয় করা জমিতে ঘর বেঁধে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর বসবাস করছেন। জমিতে তাদের বসতবাড়ি আছে, আছে চাষাবাদ। এই জমি দখল করতে একটি প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন চেষ্টা করছিল। তার বাবার মৃত্যুর একমাস পর তাদের তাড়িয়ে দিয়ে জমিটি দখল করে নিয়েছেন। ঘর তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে তারা গ্রামেরই আব্দুল মজিদের বাড়িতে থাকছেন। ভাই দুটি বারান্দায় থাকেন, প্রাপ্তবয়ষ্কা হওয়ায় দুইবোন থাকেন ঘরে ভেতরে।
নিশ্চিন্তপুর গ্রামের এতিম চার ভাই-বোন হচ্ছেন কবিতা খাতুন (২৩), ইমরান হোসেন (২১), কেয়া খাতুন (১৩) ও আরাফাত হোসেন (১১)। এদের বাবা আবুল কাশেম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮ মাস পূর্বে মারা গেছেন। আর মা আনজুরা বেগম আনুমানিক ২ বছর পূর্বে সাপের কামড়ে মারা যান। প্রতিবেশিরা জানান, তারা হতদরিদ্র পরিবার। বাবা আবুল কাশেমরা চার ভাই। দুই ভাই মারা গেছেন, এক ভাই থাকেন ঢাকায়। ভিটেমাটি না থাকা আবুল কাশেম বাড়ি থেকে আনুমানিক ৪ শত গজ দুরে শশুরের দেওয়া জমিতে বসবাস করতেন।
সরেজমিনে নিশ্চিন্তপুর গিয়ে দেখা যায় এতিম চার ভাই-বোন আব্দুল মজিদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ভাই ইমরান হোসেন অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করেন। বড় বোনটি বাড়ির কাজ করেন। ছোট দুই ভাই-বোন ৫ম শ্রেণীতে পড়ছে। বোন কবিতা খাতুন জানান, তারা জমাজমি নিয়ে বেশি কিছু বোঝেন না। শুধু এইটুকু যানেন বাবা তার শশুরের দেওয়া জমিতে বসবাস করতেন। তার নানা আতর আলী ৭২ শতক জমি ক্রয় করেন। এই ৭২ শতক জমিতে তারা বসবাস করতেন।
গ্রামের আব্দুল মজিদ জানান, বাচ্চাদের মানবিক কারনে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাচ্চাদের নানা আতর আলী ও এক চাচা আব্দুস সাত্তার এই এক একর ৪২ শতক জমি কিনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে জমিটি সরকারের ঘরে চলে যায়। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে গ্রামের ৮ ভুমিহীনকে জমিগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। সেখানে শর্ত থাকে এই বন্দোবস্ত পাওয়া জমি তারা বিক্রয়, দান বা অন্য কোনো প্রকার হস্তান্তর করতে পারবে না। কিন্তু ভুমিহীনদের মধ্যে চারজন বন্দোবস্ত পাওয়া জমি অন্যের কাছে বিক্রি করে দেন। তাদের গ্রামের হাফিজুর রহমান, অহিদুল ইসলাম, ইমদাদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, শহিদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন জমিগুলো ক্রয় করেন।
আব্দুল মজিদ আরো জানান, সরকারের বন্দোবস্ত দেওয়া জমি ক্রয়-বিক্রয় শুরু হলে আবুল কাশেম তার প্রতিবাদ জানান। তিনি প্রশাসনের দপ্তরে বন্দোবস্ত বাতিলের দাবি করেন। এ নিয়ে যারা জমি ক্রেতাদের সঙ্গে কয়েকদফা বিরোধও হয়। পরে দুইজনের বন্দোবস্ত চুক্তি বাতিল হয়। ৮ মাস পূর্বে আবুল কাশেম মারা গেলে বাচ্চাগুলোর উচ্ছেদের চক্রান্ত শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ছেলে ইমরান হোসেন জানান, গত ১৬ মে তাদের ঘরের সঙ্গে আমির হোসেন খড়ের পালা তৈরী করছিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বচসা হয়। এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কিও হয়। ঘটনার পর নিজ বাড়িতে থাকা আমির হোসেনের পুত্র আলমগীর হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই মৃত্যুকে পুজি করে তারা একটি হত্যা মামলা দিয়েছেন। তাদের ভাই-বোনদের বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিয়েছেন। অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় আলমগীর হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে প্রমান হয়েছে মর্মে তিনি দাবি করেন।
যারা ওই জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন এবং ক্রয় করেছেন তাদের একজন হাফিজুর রহমান জানান, জমিটি আতর আলী ক্রয় করেছিল ঠিক। কিন্তু জমির কাগজপত্রে ত্রæটি থাকায় সেটা সরকারের হয়ে যায়। সরকার পরবর্তীতে ৮ জনের মধ্যে বন্দোবস্ত দেন। এই বন্দোবস্তের কারনে ওই দাগে আবুল কাশেমের আর কোনো জমি নেই। তারপরও আমির হোসেন তাদের থাকতে দিয়েছিল। কিন্তু সেই আমির হোসেনের সঙ্গে গোলমাল করায় এখন তাদের থাকতে দিতে চান না। তিনি আরো জানান, ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই ঘরে তালা দিয়েছে। পরে আমিরও তালা ঝুলিয়েছে।
এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভুমি) সুজন সরকার এর মুটোফোনটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।