বিশ্বনাথে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ঠেলাগাড়ি চালান ওয়াছিব উল্লা

যে বয়সে সন্তান-নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে থাকার কথা, আর সে বয়সেই ভাবতে হচ্ছে পেট নিয়ে। বিশ বছর আগে যে হাতগাড়ি (ঠেলাগাড়ি) ধরেছিলেন জীবকার তাগিদে, তা আজও ধরে রয়েছেন। ঠেলাগাড়ি চালিয়ে ছেলে-মেয়ে বড় করেছেন, তাদের ঘরে ছেলে-মেয়ে হয়েছে। তবে শেষ বয়সে এসে একটু আরাম-আয়েশে জীবন কাটাবেন, তা আর হয়ে ওঠেনি। ছেলে সন্তান থাকলেও দায়িত্ব নেন না বৃদ্ধা বাবার। তাই জীবন যুদ্ধে দু- বেলা দু-মুঠো ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ৮৫ বছর বয়সে সংসারের ঘানি কাঁধে নিয়ে ঠেলা গাড়ি (হাত-গাড়ি) চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন সিলেটের বিশ্বনাথের ওয়াছিব উল্লা। তিনি উপজেলার চান্দসির কাপন গ্রামের মৃত কুদরত উল্লার ছেলে। দীর্ঘ ২০ বছরে ধরে তিনি এ গাড়ি চালিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মাথা গোছার ঠাই নেই তাঁর। ভাড়া বাসায় স্ব-পরিবারের বসবাস করে আসছেন র্দীঘদিন ধরে। ঠেলা-গাড়ি চালিয়ে বর্তমানে ৫ সদস্যদের পরিবার কোনো মতে চালাচ্ছেন তিনি।স্থানীয়রা জানান, রাজধানী ঢাকা ও সিলেট শহর থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্যে পার্সেল গাড়ি ও বাস গাড়ি করে প্রতিদিন উপজেলা সদরে আসে। আর এসব পূন্যে উপজেলা সদরের অবস্থিত পুরান বাজার ও নতুন বাজারে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ঠেলা গাড়ি দিয়ে নিয়ে যান ওয়াছিব উল্লা। এতে দোকান মালিক মালামাল বহণ করে দেয়ার জন্য ওয়াছিব উল্লাকে ২০-৩০টাকা দিয়ে থাকেন। এভাবে প্রতিদিন তিনি ব্যবসায়ীদের পন্যে দোকানে পৌছে দিয়ে টাকা আয় করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন তিনি। সংসারে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিও তিনি নিজে। বয়সের কারণে সোজা হয়ে হাটতে পারেন না ঠিকমতো। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রতিদিন ঠেলা গাড়ি নিয়ে বাইরে যেতে হয়। দিনে ১৫০/২০০ টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে কোনরকম সংসার চলে তাঁর। কোন কোন দিন না খেয়েও থাকতে হয়। তবে তিনি ভিক্ষা করেন না। আত্ম মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। এই বয়সে সংসারে বিশ্রামে থাকার কথা, নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দে থাকার কথা। কিন্তু তার ভাগ্যটা অন্যরকম।ওয়াছিব উল্লা জানান, উপজেলার সদর ইউনিয়নের চান্দসির কাপন গ্রামে তাঁর পিতৃক ভিটা ছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে তা বিক্রি করে উপজেলা সদরে চলে আসেন। উপজেলা সদরের সাব-রেজিষ্ট্রারী অফিসের সামনে সরকারি জায়গায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু গত বছরের ওই জায়গা থাকে ছেড়ে দিতে হয়। বর্তমানে ২ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় স্ব-পরিবারের বসবাস করে আসছেন। তাঁর নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। জীবনে তিনটি বিয়ে করেন তিনি। এক স্ত্রী অনেক আগে মারা যান। বর্তমানে দুই স্ত্রী রয়েছেন। দুই স্ত্রীর তাঁর ৫ ছেলে ও ১০ মেয়ে সন্তান রয়েছেন। তিন ছেলে-নয় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরা চলে গেছে অন্যের সংসারে আর ছেলেরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এখন বুড়ো-দুইবুড়ি-দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। শরীর আর আগের মতো ঠিক নেই। আগে মতো বেশী দূর যেতে পারিনা। ঠেলা গাড়ি ভাড়ায় চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি মাসে তিন টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। তবে অর্থের অভাবে ব্যাটারীচালিত ভ্যানগাড়ি ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছেনা।তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে তিনি মানুষের পণ্যে বহন কাজ শুরু করেন। আগে অনেক প্রবাসীরা এলাকায় আসতেন। তখন কিন্তু তেমন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিলনা। ওই সময় তিনি মাথায় ঘরে প্রবাসীদের মালামাল নিজ নিজ বাড়ি দিয়ে আসতেন। তাই দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য ওই বয়সেই কাজে নামতে হয়। কখন যে পায়ে হেটে ঠেলা-গাড়ি তার জীবন আটকে যায় তা তিনি নিজেও জানেন না। রোজগারও আগের মতো ভালো না। এখন প্রতিদিন ১৫০-২০০টাকা রোজগার করি। সকাল ৮টায় বের হয়ে রাত ৯টায় বাসায় যাই। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। অনাহারে অর্ধাহারে দিন চলে। তবে সরকারি বয়স্ক ভাতা পাই। প্রতিদিন রোজগার করা টাকা ও বয়স্ক ভাতার টাকায় কোনো মতে চলে সংসার। এলাকার প্রবাসীরা ঈদে খাদ্য সামগ্রী কিংবা বিভিন্ন সময়ে খাদ্য ও পোষাক বিতরণ করলে ছুটে যাই। এলাকার বৃত্তবান ও সরকারের সহযোগিতা পেলে জীবনের শেষ বয়সে নিজের মাথা গোছার জন্য সামান্য কিছু জমি ক্রয় করতে পারলে খুশি হতাম।এব্যাপারে বিশ্বনাথ সদর ইউপি চেয়ারম্যান ছয়ফুল হক বলেন, আমি ছোট বেলা থেকে তাকে (ওয়াছিব উল্লা) ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের দোকানের মালামাল ঠেলা গাড়ি দিয়ে বহণ করে আসছেন। তাকে ও তাঁর স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়।তিনি বলেন, সরকারি আশ্রয় প্রকল্প যেতে চাইলে তিনি সকল ধরনের সহযোগিতা করবেন। তবে সে (ওয়াছিব) আশ্রয় প্রকল্পে কেন্দ্র যেতে চায় না।উপজেলা নির্বাহী অফিসার বর্নালী পাল বলেন, আশ্রয় প্রকল্পে তিনি (ওয়াছিব) আবেদন করলে তাকে সহযোগিতা করা হবে।