ভাঙ্গুড়া (পাবনা) প্রতিনিধি
গত বুধবার পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তি, পাঠদান কার্যক্রম ও পরীক্ষার ফলাফলে ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান সন্তোষজনক। তবে নানা অনিয়ম, অভিযোগ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা চলার পরেও উপজেলার অষ্টমনিষা টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ এমপিও ভুক্ত হওয়ায় বিস্মৃত হয়েছেন এলাকাবাসী।
জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের অর্থায়নে পাবনার বেঙ্গলস্টার এরিয়া ওয়ার্ক সোসাইটি নামে একটি এনজিও ১৯৯৯ সালে ভাঙ্গুড়া উপজেলায় তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য জায়গা খোঁজ করে। তখন অষ্টমনিষা ইউনিয়নের অষ্টমনিষা গ্রামে একটি বিদ্যালয়ের জন্য মানিকজান নামে এক ব্যক্তি ৩৩ শতক জমি ওই এনজিওর মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরকে দান করেন। সেসময় সরকারি অর্থায়নে ওই জায়গায় বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও আসবাবপত্র বানানো হয়। পরে ২০০৪ সালে এনজিওর অর্থাভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে ওই জায়গা ও আসবাবপত্র সহ বিদ্যালয়ের আধাপাকা টিনশেড ঘর দখল করে ২০০৪ সালে অষ্টমনিষা টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ স্থাপন করে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলেজে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক। পরে পাশে আরও ২৫ শতক জমি ক্রয় করেন তারা। যদিও এমপিও নীতিমালা অনুসারে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের জায়গার আয়তন নূন্যতম এক একর হওয়া বাধ্যতামূলক। সে সময় পাশের চাটমোহর উপজেলার আটলংকা ডিগ্রী কলেজের অংক বিষয়ের প্রভাষক ও অষ্টমনিষা গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুর রহমান অষ্টমনিষা টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে শাহিনুর রহমান দুই প্রতিষ্ঠানেই চাকুরি করে চলেছেন। তবে দীর্ঘদিন এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অন্য শিক্ষকরা কলেজ ছেড়ে চলে যান। আটলংকা ডিগ্রী কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষক হওয়ায় অধ্যক্ষ শাহিনুর মাসে দুয়েকদিন অষ্টমনিষার কলেজে আসতেন। তিনি নিয়মিত না আসায় অন্য শিক্ষকরাও কলেজে আসতেন না। এতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম আছে শুধু কাগজ কলমে। এঅবস্থায় ১৫ বছর আগে বিএম কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হলেও আজও প্রতিষ্ঠানটির নেই নিজস্ব জায়গা, ভবন ও পাঠদানের জন্য উপযুক্ত কোনো শ্রেণিকক্ষ। স্থানীয়দের অভিযোগ কলেজটিতে কখনোই নিয়মিত ক্লাস হতো না। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে শুধু পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হতো। কলেজের অফিস সহকারি নুর মোহাম্মদ সকালে এসে শুধু জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন এবং বিকাল হলে নামাতেন।
এমপিওভুক্তি ঘোষণার পরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলেজটি এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দখল করে রাখলেও ভবনের সেই কক্ষগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দুটি কক্ষে পাটখড়ি ও শুকনো গো-বর্জ্য রেখেছে প্রতিবেশীরা। অন্য দুটি কক্ষে তিন-চারটি চেয়ার-বেঞ্চ ভেঙ্গে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কক্ষের ভেতরে ময়লার স্তর দেখে মনে হয় কখনো এখানে পাঠদান কার্যক্রম চলেনি।
এদিকে এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত উপজেলার তিনটি বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্য দুটি বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়ে যায়। কিন্তু এই টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে অষ্টমনিষা গ্রামের এই স্কুলটি জাতীয়করণ হয়নি। তবে বিদ্যালয়টি পুনরায় চালু করতে ওই জায়গা ও ভবন উদ্ধারে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে উপজেলা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হয়। পরিশেষে বিদ্যালয়টি উদ্ধারে এ বছরের মার্চ মাসে বিদ্যালয়ের সভাপতি ইনাম হোসেন কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান সহ সংশ্লিষ্ট আরও তিন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে পাবনার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের আওতায় আনতে ওই কর্তৃপক্ষও বিদ্যালয়টি কাগজ-কলমে চালু রেখেছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদ উজ্জল বলেন, সরকারি শর্ত মোতাবেক কলেজের নিজস্ব জায়গা ও ভবন নেই। সরকারি রাস্তা এবং তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা ও ভবন জোরপুর্বক দখল করে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেখিয়েছে। কখনোই সেখানে ক্লাস হতোনা। বিএম কলেজটি বাহিরের ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীকে কাগজে-কলমে দেখিয়ে এমপিও ভুক্ত হয়েছে।
অষ্টমনিষা হাসিনা মোমিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, অষ্টমনিষা টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজে কখনোই পাঠদান কার্যক্রম চলত না। শুধু কাগজ-কলমে কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি দেখিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হতো। এরপরও একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে এমপিওভুক্ত হলো তা বোধগম্য নয়। অথচ এরচেয়ে অনেক ভালো মানের প্রতিষ্ঠান নন-এমপিও রয়ে গেছে।
দুইটি কলেজে চাকুরি করার বিষয়টি স্বীকার করে অষ্টমনিষা টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ শাহীনুর রহমান বলেন, ‘এমপিওভুক্তির নীতিমালা সম্পর্কে আমার ভালোভাবে জানা নেই। তাই একসাথে দুটি কলেজে চাকুরি করেছি। এখন বিএম কলেজ এমপিওভুক্তি হয়েছে তাই আরেকটি কলেজের চাকুরি ছেড়ে দেব। আর পাঠদান কার্যক্রম না চলা এবং কলেজের জমি সংক্রান্ত আইনি জটিলতার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।’