॥ আবদুল জব্বার ॥
পর পর তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার। পদ্মা সেতু মেট্রোরেলসহ নানা উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড দেশের মধ্যে অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ- যুবলীগের এক শ্রেণির নেতা-কর্মীর বির্তকিত কর্মকান্ড সরকারের অর্জন সমূহ ম্লান করে দিচ্ছে। নানা দূর্ণীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতা শোভন ও রব্বানীকে অপসারন করার পরও বন্ধ করা যায়নি এদলটির নেতা-কর্মীদের অনিয়ম ও বির্তকিত কর্মকান্ড।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফরহাদকে গত ৬ অক্টোবর নিমর্ম ভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। হত্যার শিকার হওয়ার আগে শেষ চার ঘন্টার নির্মম নিযার্তনের চিত্র উঠে এসেছে আদালতে আসামীদের দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দীতে।
ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮ টা থেকে সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা কে কীভাবে অসহায় আবরার ফাহাদের উপর বর্বরত নির্যাতন চালিয়েছে তা এখন পরিস্কার। ১৩ অক্টোবর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা মুজাহিদুর রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এর আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বুয়েটের ছাত্র ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং অনিক সরকার। ৪ জন আসামির জবানবন্দি অনুযায়ী ১৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরে বাংলা হল শাখার ছাত্রলীগের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে মেসেঞ্জার গ্রুপে উত্তর দেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা। গ্রুপে সে লেখে ওকে (আবরার) বাড়ী থেকে ফিরতে দেন। এর পর ৬ অক্টোবর বিকালে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ফিরে আসেন আবরার। এদিন রাত ৮ টার পর আবরারকে হলের কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় তানিম, সাদত, সাইফুল ও অভি। এর পর সকলে মিলে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারকে শিবিরের কর্মী উল্লেখ করে চড় থাপ্পর এবং ক্রিকেট স্ট্যাস্প দিয়ে বেধরক পেটাতে থাকে। এদিন রাত সাড়ে ১২টার পর্যন্ত পর্যায় ক্রমে নিষ্ঠুরতার সাথে পিটিয়ে তারা হত্যা করে আবরার ফরহাদকে। ঘটনার পর কোনো অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়নি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কেউ এঘটনার পর পালিয়েও যায়নি। এ রাতের বর্বরতম হত্যা কান্ডের ঘটনা আমাদেরকে বেদনাহত ও শোকাহত করে। কোনো সভ্য সমাজে কোনো বিবেকমান মানুষ এরকম ঘটনা ঘটাতে পারে না। আবরারের শোকাহত পরিবারের সাথে গোটা জাতি এখন শোকাহত।
পুলিশ ইতোমধ্যে হত্যাকারিদের গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে ১৬৪ ধারা মতে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। ঘটনার পর বুয়েট সহ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ক্ষমা চেয়েছেন বুয়েটের ভিসি। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ১৯জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষ আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ সহ মামলার খরচ প্রদানে সম্মত হয়েছেন। সেই সাথে বুয়েটের ছাত্র রাজনৈতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট বুয়েটের মিক্ষার্থী আবরার ফহাদ হত্যাকারিদের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করার দাবি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরারের পিতা-মাতাকে শান্তনা দিয়ে বলেছেন, স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। তিনি আবরার হত্যা মামালার দ্রুত শেষ করার জন্য আইনমন্ত্রীকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেখানেই অনিয়ম সেখানেই অভিযান পরিচালনা করার জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন তিনি।
আজ দুঃখ ও পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় এদেশে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরাই একদিন ৫২ এর ভাষা আন্দোলন দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনসহ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সাথে সংহতি ছিল সমগ্র দেশবাসীর। ছাত্ররা নিজেদের সমস্যাসহ গণ মানুষের সকল রকমের সমস্যা নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলন সংগ্রাম করতেন। তৎকালীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতেন। এখানে উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের মুক্তিকামী জনগনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে ১ জানুয়ারি মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করাকালিন সময়ে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল/কাদের নিহত হয়েছিলেন। সাবেক সৌরশাসক এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে ডা. মিলন শহীদ হয়েছিলেন। এরকম অনেক গৌরবজ্জল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তৎকালিন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা।
১৯৬৭ সালে সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় আমি তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হই। এরপর ৬৮/৬৯ সালের গণ আন্দোলন, গণ অভ্যুথানে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযদ্ধকালীন সময়ে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগ বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠিত হলে আমি ওই গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করি। ৯ মাস ব্যাপি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি।
এরপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্থানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বিজয়ীর বেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের মার্চ/এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ক্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি একজন ডেলিগেট হিসেবে ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “নীতির যেখানে মিল সেখানেই মনের মিল হয়” বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের এক সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার আহবান জানিয়ে ছিলেন। এদিন খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা ও তার বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
দেশবাসীর প্রত্যাশা প্রধান মন্ত্রীর কঠোর পদক্ষেপ এবং বুয়েটের মেধাবি ছাত্র আবরার ফাহাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশের ছাত্র অপ রাজনীতির অবসান ঘটবে। দেশের ছাত্র সমাজ অতীতের গৌরবজ্জল ভূমিকা পুনরায় ফিরে পাবে। লেখক, বীরমুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী। ই-মেইল- ুধননধৎ.ঢ়ধনহধ@মসধরষ.পড়স
আবদুল জব্বার
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব