বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে যেতে চান

–এবাদত আলী —

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারি বীর মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাবেক কমান্ডার আলহাজ মোঃ আব্দুস সামাদ বলেন ,আমরা যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে এদেশ স্বাধীন করেছিলাম আমাদের সে স্বপ্ন আজো পুরণ হয়নি। যে দেশে মহান স্বাধীনতার স্থপতিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং যে দেশের মাটিতে রাজাকার আলবদররা আজো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের
সকল আশা-আকাঙ্খা আজো অপুর্ণই রয়ে গেছে।
কথাগুলো বলছিলেন সুজানগর শহীদ দুলাল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারি শিক্ষক এবং সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুজানগর উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মোঃ আব্দুস সামাদ।
সুজানগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের মৃত খোরশেদ আলীর পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ বলেন তখন আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা অনার্সের ছাত্র। সারা দেশ জুড়ে চলছে আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাতকোটি মানুষ যেন একই সুত্রে গাঁথা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি সেসময় এ দেশের সাধারণ মানুষের উপর ক্রমান্বয়ে ষ্টিম রোলার চালিয়ে যেতে থাকে। দেশের শান্তিকামী মানুষের সাথে ছাত্র সমাজ তখন ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার। দিন গড়াতে গড়াতে একসময় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চলতে থাকে গভীর ষড়যন্ত্র।
২৫ মার্চ রাতের বেলা পাকিস্তানি হায়েনার দল অতর্কিতে ঢাকার পিলখানাসহ ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, এই স্লোগানে আমরাও শত্রু হননে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
ঢাকায় আক্রমণের পরপরই পাবনা শহর ও শহরতলীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে নির্বিচারে লোকজনকে হত্যা করতে থাকে। আমরা প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের পথে পা বাড়ালাম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ বলেন, আমি, আতাইকুলা পীরপুরের জয়েন উদ্দিন, আব্দুল হামিদ, আপাল ও মধু এই কজনা মিলে বাড়ি থেকে বের হলাম। পায়ে হেঁটে পদ্মা নদীর ধার দিয়ে চলতে চলতে একসময় পদ্মা নদী খেয়া নৌকায় পার হয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পৌঁছলাম। সেখান থেকে বারাগাংদিয়া বাজার এবং সেখান থেকে শহড়াতলা গ্রামের মধ্য দিয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছে গেলাম। আমরা রাতের বেলা একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। পরদিন খুব ভোরে উঠে আবার হাঁটা শুরু করলাম। একসময় আমরা কেচুয়াডাঙা ট্র্যানজিট ক্যাম্পে গিয়ে উঠলাম। সেখানে আমাদের মত হাজারো যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য নাম লেখাতে ব্যস্ত। আমাদেরকে সেখানে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলো। এরপর টেন্ডুয়াতে চাকতারা সেনানিবাসের পাশে অন্যান্য যুবকদের সঙ্গে আমাদেরকে হায়ার ট্রেনিংএর জন্য পাঠানো হলো। টেন্ডুয়া ক্যাম্পে মোট ৫৯ দিন বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেয়া হলো। প্রতি দিন ভাতার পরিমাণ ছিলো ১ টাকা। আমাদের যাাঁরা ট্রেনিং প্রদান করতেন তাঁরা হলেন, মেজর আরকে মালাহোতরা, মেজর চৌহান, ক্যাপ্টেন তেওয়ারি,ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল (পরবর্তীতে মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন)। এই ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন কর্ণেল ডোগরা।
ট্রেনিং শেষে আমাদেরকে ব্যারাকপুরে পাঠানো হলো। সেখানে সাত দিন অবস্থান করার পর বিভিন্ন টিমে ভাগ করা হলো।
আমাদের টিমে মোট যোদ্ধা ছিলেন ৭০ জন। আর এই টিমের দায়িত্ব দেয়া হলো আমার উপর। আমরা মোট ৭১ জনের এই দলটি পাবনার পথে পা বাড়ালাম। আমরা প্রথমে মহিষবাথানে আসি। সেখানে দু’রাত অবস্থান করি। কুরিয়ারের মাধ্যমে খবর নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পাকশি চলে আসি। সেখান থেকে পূব-দক্ষিন দিকে গিয়ে সানিকদিয়াড় চরে আমরা অবস্থান নেই। পরের দিন রাতের অন্ধকারে আমরা সুজানগর পৌঁছে চরতারাপুর কোলচরি গ্রামের গনি প্রিন্সিপালের বাড়িতে আশ্রয় নেই। এসময় ক্ষণিকের জন্য বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করি।
এরপর ক্রোরদুলিয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের বাড়িতে আমরা অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইকবালের গ্রুপের সাথে একত্রিত হয়ে এলাকার যুবসমাজকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। প্রশিক্ষণ প্রদানের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে যুবসমাজকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে আরম্ভ করি। অর্থাৎ বিএল এফ এর সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকি।
গোপন সুত্রে খবর পেয়ে আমরা নগরবাড়ি রোডের বদনপুর ব্রিজে ব্রিজ প্রহরারত রাজাকারদের উপর অতর্কিতে হামলা চালাই এবং ৬ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করাই।
এধরণের বহুসংখ্যক অপারেশন চালিয়ে আমরা সফল হতে থাকি। হঠাৎ একদিন ২৫/২৬ জন ইপিআর পাকিস্তানি আর্মিদের দল হতে অস্ত্রশস্ত্রসহ পালিয়ে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে এসে হাজির হয় এবং আমাদের দলে যোগ দেয়। আমরা তাদেরকে তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করি। দু’দিন অবস্থানের পর ইকবাল ভাই তাদেরকে সঙ্গে করে ভারতে নিয়ে যান। যাবার সময় তাদের অস্ত্রগুলো আমাদের কাছে রেখে দেয়া হয়। এতে আমাদের শক্তি ওসাহস আরো বৃদ্ধি পায়।
ইতোমধ্যে আমাদের দলটি পাবনা- সুজানগর রোডের শ্রীকোল ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পাবনার সঙ্গে সুজানগরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সুজানগর থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি আর্মি ও মিলিশিয়া বাহিনী এবং রাজাকারেরা নিজেদেরকে অসহায় বোধ করতে থাকে। এই সুযোগে আমরা সুজানগর থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকি।
ইতোমধ্যে আরেকটি বড় ধরণের অপারেশন চালানো হয় নাজিরগঞ্জ বাজারের কাছে। এদিন নদী পথে একদল পাকিস্তানি সৈন্য একটি কার্গো ফেরিতে করে সৈন্যদের জন্য মালামাল ও অস্ত্রশস্ত্র বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলো। এই খবর পাবার পর জহুরুল ইসলাম বিশু, শামসুল এবং আমার নেতৃত্বে মুত্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। উভয় পক্ষে গোলাগুলির পর অবশেষে ফেরিটি ডুবে যায়। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মিরা পালাবার পথ না পেয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়।
এ ঘটনার কদিন পর ১১ ডিসেম্বর আমরা সুজানগর থানায় আক্রমণ চালাই। থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি আর্মি, মিলিশিয়া বাহিনী, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। উভয় পক্ষের মাঝে তুমূল লড়াই শুরু হয়। এই যুদ্ধে আরসিএল গানের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহুরুল ইসলাম বিশু আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। পাবনার নুরল ইসলাম নুরু শহীদ হন। ১২ তারিখে যুদ্ধ করতে করতে ইব্রাহীম মোস্তফা কামাল দুলাল শহীদ হন। উলাট গ্রামের আবু সাঈদের চোখে গুলি লেগে তার দ’টি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। এসময় মুক্তি বাহিনীর গুলিতে চারজন পাকিস্তানি আর্মি নিহত হয়। ১৩ তারিখে শহীদ হন দ্বিপচরের আবু বক্কার।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সুজানগর থানা হানাদার মুক্ত হলে আমরা থানা দখল করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করি এবং আমি সুজানগর থানার কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ একান্ত সাক্ষাতকারে এই প্রতিবেদককে বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। বেশ কজন মানবতা বিরোধীকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। বাকিদের বিচারের কাজ ধীর গতিতে চলছে। বাংলার মাটিতে একাত্তরের সেই সকল খুনিদের বিচারের রায় অনতিবিলম্বে ঘোষণা পুর্বক তা কার্যকর করা হোক। আর আমি সেই দিনটির জন্য অপেক্ষায় আছি। (লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

এবাদত আলী
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।
মোবাইল: ০১৭১২২৩২৪৬১