জয় বাংলা’র ৫০ বছর

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সোমবার। সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা চলছিল। সে সভার আলোচ্য বিষয় ছিল শিক্ষা দিবস যৌথভাবে পালনের কর্মসূচী প্রনয়ন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি সংক্রান্ত। আলোচনার এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ হঠাৎ করে ” জয় বাংলা ” বলে চিৎকার করে উঠেন। সাথে সাথে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান ( ‘৭১ সালে শহীদ) জয় বাংলা বলে প্রতিউত্তর দেন। উক্ত ঘটনায় আকস্মিকভাবে উপস্থিত নেতাকর্মী চমকিত হন। সভায় বার বার জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ হতে থাকলে প্রতিউত্তর দেবার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বলা হয়ে থাকে, সেটাই বাংলার মাটিতে প্রথম প্রকাশ্যে জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারন।

সেদিনের পর ছাত্রলীগের একাংশের মধ্যে জয় বাংলা শ্লোগান বিষয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হলেও সংগরিষ্ঠ নেতা কর্মীরা শ্লোগানটি লুফে নেন। বিশেষ করে ১৯৬২ সালে গঠিত নিউক্লিয়ার্স গ্রুপ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ জয় বাংলা শ্লোগানটি বাঙালীর স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা প্রকাশ করার জন্য প্রতিকী শ্লোগান হিসেবে গ্রহন করেন। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের একাংশের বিরোধিতা সত্বেও ১৯৭০ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করেন। তারপর জয় বাংলা শ্লোগান হয়ে উঠে বাঙালীর অধিকার আদায়ের প্রথম এবং প্রধান শ্লোগান।

১৯৭০ সালের জুন জুলাই মাসের দিকে জয় বাংলা শ্লোগানটি ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন পাবনা শহরের সর্ব বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাধানগর মজুমদার একাডেমীর ছাত্র। স্কুল ছাত্রলীগের সভাপতি। ১৯৬৯ সালে গন আন্দোলনের সময় গঠিত বৃহত্তর পাবনা জেলা সর্বদলীয় স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক। ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে সারাদেশব্যপী স্কুল ছাত্রদের পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলনে গঠিত কমিটির যুগ্ম আহবায়ক। ৬৭ থেকে ৭০ এর সকল আন্দোলন ও সংগ্রামের সক্রিয় কর্মী। মিছিল – মিটিং, পোষ্টার লাগানো, দেয়াল লিখন এমনকি বঙ্গবন্ধুর পাবনা আগমন উপলক্ষে প্রচার প্রচারনা দলের সদস্য ছিলাম। সক্রিয় রাজনীতি করার সুবাদে পাড়ার নেতাকর্মী থেকে শুরু করে জেলার নেতাদের কাছে বেশ পরিচিত ছিলাম। একারণে জয় বাংলা শ্লোগান পাবনায় আসার পর তার সাথে পরিচিত হই।

১৯৭০ সালে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আব্দুস সাত্তার লালু এবং সাধারন সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল। এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন অখিল রঞ্জন বসাক ভানু এবং জিএস খোন্দকার আওয়াল কবীর। তৎকালীন পাবনা ইসলামিয়া কলেজ ( বর্তমান শহীদ বুলবুল কলেজ) এর ভিপি ছিলেন আব্দুল কাদের ( বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান)। উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ ছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে পাবনার ছাত্র আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

১৯৭০ সাল হলো মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতির বছর। আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন আর ছাত্র নেতারা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমনি একটি সময়ে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ পাড়া মহল্লায় বাঙালী জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করছেন। এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ আমাদের মত তরুন কিশোর যুবকদের নিয়ে বৈঠক করেন। বিভিন্ন শ্লোগান লিখিতভাবে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারমধ্যে প্রথম ছিল জয় বাংলা। এছাড়া উল্লেখযোগ্য শ্লোগান ছিল, আমি কে তুমি কে – বাঙালী বাঙালী। আমার তোমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যুমনা। ঢাকা না পিন্ডি – ঢাকা ঢাকা। আমার নেতা তোমার নেতা – শেখ মুজিব শেখ মুজিব। এই সব শ্লোগান মিটিং মিছিলে দলবদ্ধভাবে উচ্চারণ করা ছাড়াও পাড়া মহল্লায় দেয়াল লিখন এবং হাতে লেখা পোষ্টার লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বাইরে আমরা সম্মিলিতভাবে জারী গানের মত একটা সংগীত পরিবেশন করতাম। গানের কথাগুলি ছিল, আমরা ভুলবো না – ভুলবো না পাকিস্তানী শোষন ভুলবো না। এই মাটিতে জন্ম মোদের – জন্ম নিছে নেতা, আর এই মাটিতে জন্ম নিছে মোনায়েম হারামজাদা। মোরা ভুলবো না – ভুলবো না পাকিস্তানী শোষন ভুলবো না। গানের সব কথা এই রকম থাকলেও শেষে পাকিস্তানের দালালদের নাম বলা হতো। যেমন একবার মোনায়েম খান, একবার সবুর খান, একবার ক্যাপ্টেন জায়েদীর নাম বলতাম। স্থানীয় দালালদের নামও বলতাম। এটাও তখন জনপ্রিয় প্রচারনা ছিল।

১৯৭০ সালের শেষ দিকে পাবনার বানী সিনেমা হলে জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেওয়া ছবিটি মুক্তি পেলো । প্রায় একমাসের বেশী সময় ধরে সেই সিনেমাটি পাবনায় প্রদর্শিত হয়েছিল। একথা বলা যায়, সেসময় জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্র আর জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিকে অনেকাংশে ভুপাতিত করা হয়েছিল। এখনো মনে পড়ে আমাদের জেলা ছাত্রলীগের নেতারা প্রতিদিন একদল ছাত্রলীগ কর্মীকে সিনেমা হলে প্রবেশ করাতেন। তাদের কাজ ছিল সিনেমার বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে জয় বাংলা বলে শ্লোগান দেওয়া। ছাত্রলীগের এমন প্রচারনা শুরু হলে সে সময় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ যারা পাবনায় নক্সাল বলে পরিচিত তারাও একই পদ্ধতি গ্রহন করে। ছাত্রলীগ জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে উঠলে তারা বলে উঠতো জয় সর্বহারা। তবে শ্লোগান প্রদানে জয় বাংলা’র অবস্থান ছিল শীর্ষে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন থেকে ৭১ এর মার্চ মাত্র তিনমাস সময়ের মধ্যে জয় বাংলা শ্লোগান হয়ে উঠলো বাঙালী জাতির স্বাধীকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের মুল প্রেরনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা শ্লোগান ছিল বাঙালীর আত্মমর্যাদার প্রতীক। নয়মাসে মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা শ্লোগাল ছিল শত্রুদের কাছে ভয়াবহ অস্ত্র। জয় বাংলা বলে শত্রুকে আঘাত করা আর জয় বাংলা বলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিসর্জন দেওয়ার যে অমর কৃতি তা কখনোই বাঙালী জাতির জীবনে আসেনি। পাকিস্তানী শাসনের ২৩ বছর, ইংরেজ শাসনের ২ শত বছর আর সেন,আর্য, সুলতান, মোঘল, পতুর্গিজ, ওলন্দাজদের শাসন সহ বাঙালী জাতির হাজার বছরের পরাধীনতার জ্বাল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালে বাঙালী ফিরে পায় স্বাধীনতা।

মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা শুধু শ্লোগান ছিল না। জয় বাংলা শ্লোগান হয়ে উঠেছিল বাঙালী জাতির ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতবাসীর কাছে আমাদের পরিচয় হলো জয় বাংলা’র লোক। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বাংলার বাঙালীরা আমাদের পাশে দাড়ালো। দুই কোটি মানুষকে আশ্রয় দিলো, খাদ্য দিলো, প্রশিক্ষন ও অস্ত্র দিলো। এদেশের তরুন যুবকরা হলো মুক্তিযোদ্ধা। হাতে অস্ত্র আর কন্ঠে জয় বাংলা। হানাদার বাহিনীর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, আতঙ্কিত নাম। তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের বলতো জয় বাংলার লোক। জয় বাংলা নয়মাসে পরিনত হলো স্বাধীন বাংলাদেশে।

স্বাধীন বাংলাদেশ হলো। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ আবার বিধ্বস্ত হলো। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিভক্ত হলো। জয় বাংলার চেতনা ভূলন্ঠিত হলো। যারা জয় বাংলা শ্লোগানের উদ্ভাবক তারা নিরাশ হলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি সময় জয় বাংলার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন তারা জয় বাংলা শ্লোগান থেকে সরে গেলেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে মানুষটি ১৯৬৯ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে প্রথম জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন, সেই আফতাব উদ্দিন আহমেদ ২০০৬ সালে মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত আর কখনোই জয় বাংলা উচ্চারণ করে নাই। জয় বাংলার উদ্ভাবক আফতাব উদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার পর জাসদ সমর্থিত দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ( ভিসি) হয়েছিলেন। এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া হলেও বাস্তবে আছে আরো করুন চিত্র।

জয় বাংলার ৫০ বছর সময়কালে ভয়াবহ দুর্যোগ সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জয় বাংলা উচ্চারণ নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর একুশ বছর সরকারীভাবে জয় বাংলা উচ্চারণ করা হয়নি। শুধু মাত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ ব্যতিত আর কোন দল জয় বাংলা উচ্চারণ করেনা। বিভিন্ন দলের মুক্তিযোদ্ধারাও জয় বাংলা শ্লোগান আর দেয়না । স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশক অতিবাহিত হলেও স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী জয় বাংলা উচ্চারণ করে না। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় বাংলা ছিল বাঙালী জাতির শ্লোগান আর এখন জয় বাংলা হলো একটি বিশেষ দলের শ্লোগান। কেন এমন হলো? শেষ কথা হলো অনতিবিলম্বে -সাংবিধানিকভাবে জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। জয় বাংলা হোক জাতির শ্লোগান। জয় বাংলা হোক রাষ্ট্রের শ্লোগান।
( সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯