রাজশাহী জেলখানায় খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন

আমিরুল ইসলাম রাঙা

১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলখানার মধ্যে অবস্থিত খাপড়া ওয়ার্ডে আটক কমিউনিষ্ট ও বামপন্থী রাজবন্দীদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। সেই নৃশংস ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং ৩২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিল। সেই থেকে দিবসটি এই উপমহাদেশে ” ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড হত্যা দিবস ” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন মুসলিম লীগের শাসকরা প্রথম আঘাত আনেন, এদেশের কমিউনিষ্ট ও বামপন্থী সমর্থক কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সমাজের উপর। উল্লেখ্য ১৯৪৮ – ৫০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি রক্তক্ষয়ী কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়। সেই সময়ে রাজশাহী অঞ্চলে কমিউনিষ্ট নেত্রী ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে এবং যশোরের কমরেড আব্দুল হকের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়। এ সময় গোটা বাংলায় কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় সরকার কৃষক আন্দোলন দমন করতে যেয়ে সারাদেশে শত শত নেতাকর্মীকে আটক করে। এ ছাড়া ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দ্দু হবে এমন ঘোষনা করলে সারাদেশে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সে সময় ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করে জেলখানায় আটক রাখা হয়।

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে রাজবন্দীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে একটি বিল পাশ করলে সারাদেশের সমস্ত জেলখানায় রাজবন্দীদের মধ্য তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। সে সময় জেলখানায় আটক রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা জেলের অভ্যন্তরে আন্দোলন শুরু করে। জেল খানায় বন্দীদের সাথে অসদচারন বন্ধ করা সহ বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী পেশ সহ বন্দীরা অনশন কর্মসূচী গ্রহণ করে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলখানায় আটক রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে জেল কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলাকালে মতবিরোধ দেখা দিলে তৎকালীন জেলার বিনা উসকানীতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে বন্দীদের উপর গুলিবর্ষনের নির্দেশ দেন এবং জেল পুলিশ খাপড়া ওয়ার্ডে অবস্থানরত বন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭ জন বন্দীকে হত্যা এবং ৩২ জনকে গুলিবিদ্ধ করে আহত করেন।

সেদিনে পুলিশের গুলিতে নিহত বিপ্লবীরা হলেন, ১) বিজন সেন ( রাজশাহী) ২) কম্পরাম সিংহ ( দিনাজপুর) ৩) হানিফ সেখ ( কুষ্টিয়া) ৪) সুধীন ধর ( রংপুর) ৫) দেলোয়ার হোসেন ( কুষ্টিয়া) ৬) সুখেন ভট্টাচার্য ( ময়মনসিংহ) এবং ৭) আনোয়ার হোসেন ( খুলনা)। উল্লেখ্য নিহত বিপ্লবীদের মধ্যে সুধীন ধর এবং বিজন সেন ছিলেন রেল শ্রমিক। হানিফ সেখ ছিলেন, কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক নেতা। সুখেন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন, ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের স্নাতক পরীক্ষার্থী। দেলোয়ার হোসেন ছিলেন, রেলওয়ের লাল ঝান্ডা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এবং আনোয়ার হোসেন ছিলেন, খুলনার দৌলতপুর কলেজের ২ বর্ষের ছাত্র এবং সে ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ছিলেন।

গুলিবিদ্ধ আহতরা হলেন – ( ১) সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ ( মুর্শিদাবাদ এর অধিবাসী। ১৯৭৭ – ৮২ সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার ষ্পিকার ও সাবেক আইনমন্ত্রী) (২) আব্দুস শহীদ ( বরিশাল) ( ৩) আব্দুল হক ( যশোর) ( ৪) কমরেড প্রসাদ রায় ( পাবনা) (৫) আমিনুল ইসলাম বাদশা ( পাবনা) (৬) আশু ভরদ্বাজ (৭) সত্যেন সরকার ( ৮) নূরুন্নবী চৌধুরী (৯) প্রিয়ব্রত দাস ( ১০) অনন্ত দেব ( ১১) গনেন্দ্র নাথ সরকার (১২) নাসির উদ্দিন আহমেদ (১৩) শচীন্দ্র ভট্টাচার্য (১৪) সাইমন মন্ডল (১৫) কালিপদ সরকার (১৬) অনিমেষ ভট্টাচার্য (১৭) বাবর আলী ( দিনাজপুর) (১৮) গারিস উল্লাহ সরকার (১৯) ভুজেন পালিত ( দিনাজপুর) (২০) ফটিক রায় (২১) সীতাংশু মৈত্র (২২) সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার (২৩) ভোলারাম সিংহ (২৪) সত্য রঞ্জন ভট্টাচার্য (২৫) লালু পান্ডে (২৬) মাধব দত্ত (২৭) কবীর শেখ (২৮) আভরন সিংহ (২৯) সুধীর স্যানাল (৩০) শ্যামাপদ সেন ( বগুড়া) (৩১) হীরেন সেখ এবং (৩২) পরিতোষ দাস গুপ্ত।

১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডের এই হত্যাকান্ডের ইতিহাস কালের পরিবর্তনে মলিন হয়েছে। যেন এ প্রজন্মের রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে অজানা ইতিহাস। মানুষের কাছে ৭৫ এর ৩ নভেম্বর হত্যাকান্ড যত আলোচিত সে তুলনায় খাপড়া ওয়ার্ডের মত এত বড় হত্যাকান্ড নিয়ে কোন আলোচনা নাই। শুধুমাত্র কমিউনিষ্ট ও বামপন্থী হওয়ায় বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ আজ উপেক্ষিত। ঘটনার ৬৮ বছর অতিবাহিত হলেও সরকার এই বিপ্লবী শহীদদের স্বীকৃতি দেন নাই। এদেশের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সংগঠনগুলি খাপড়া ওয়ার্ড এর ঘটনা এবং শহীদদের আত্মত্যাগ নিয়ে কোন আলোচনা করেনা। অথচ ভীন দেশের বিপ্লবী ঘটনাগুলি নিয়ে দিবস পালন করেন।

পরিশেষে সরকারের কাছে দাবী করছি, খাপড়া ওয়ার্ডের বিপ্লবীদের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় ভাবে দিবসটি পালন করা হোক। শহীদ স্মৃতি অমর হোক – মেহনতি জনতার জয় হোক।

সমাপ্ত।

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।