রামিম হাসান,ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:
ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলাতেই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছিল মাদক বা ড্রাগের মতো আসক্তির খেলা জুয়া । তবে জেলার অন্যান্য স্থানের চেয়ে জুয়ার বৃহৎ কয়েকটি স্পট ছিল শৈলকুপা উপজেলাতে । এই জুয়াতে ওয়ান টেন সহ কয়েক ধরনের খেলার প্রচলন ছিল। যেখানে লাখ থেকে কোটি টাকার হাত বদল হয়ে আসছিল প্রতিরাতে । বিভিন্ন জেলা থেকে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট সহ বিভিন্ন পরিবহনে করে জুয়াড়িরা আসত জুয়া খেলতে। রাতভর চলত এই জুয়া খেলা । তবে সে চিত্র পাল্টে দিয়েছেন ঝিনাইদহের বর্তমান পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান । স্থানীয়রা বলছে, গত প্রায় ১বছর ধরে জেলার কোথাও আর জুয়ার আসর চোখে পড়ে না। সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে গেছে সর্বশান্ত হওয়ার এই মরণ নেশার খেলা । অনেক জুয়াড়ী, জুয়ায় আসক্ত তরুন-যুবক ফিরে এসেছে স্বাভাবিক জীবনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে বলেন, বর্তমান পুলিশ সুপারের কঠোর অবস্থানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের জুয়ার আসর । ঢাক-ঢাল পিটিয়ে নয়,অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই এই পুলিশ কর্মকর্তা জুয়া বন্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন।
জানা গেছে, জুয়া খেলা বন্ধে ব্রিটিশ আমল থেকেই জুয়া আইন রয়েছে, যেখানে তাৎক্ষনিক জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে । তবে এই আইনের কঠোর প্রয়োগে বা জুয়া বন্ধে বিভিন্ন সময়ে তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহ প্রশাসনের মধ্যে । বিপরীতে সংঘবদ্ধ জুয়াড়ীরা পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দিয়ে নিবিঘেœ এই ভয়ংকর নেশার খেলা জুয়া চালিয়ে আসছিল । তবে স্বদিচ্ছা, সততা আর দায়িত্ববোধের জায়গাতে অবিচল থেকে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার ঝিনাইদহ থেকে স্থায়ীভাবে জুয়া উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলার সাধারণ মানুষ। হাসানুজ্জামান ঝিনাইদহে যোগদানের পর থেকে গত প্রায় ১বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এই জুয়া খেলা।
অনুসন্ধ্যানে দেখা গেছে, মাদক বা ড্রাগ আসক্তির মতই জুয়া খেলাও এক ধরনের আসক্তি । জুয়া খেলতে খেলতে অনেক মানুষই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং এই আচরণের জন্যই তাদের গোটা জীবনটা সমস্যায় ভরে যায়। জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে তারা শুধু জুয়া খেলার সুযোগ খোঁজে এবং জুয়ার মধ্যেই নিজেদের জীবনকে ডুবিয়ে রাখে। অনেকে টাকাপয়সা খুইয়ে এবং নানা বিপত্তি সত্তে¡ও জুয়া খেলা ছাড়তে পারে না। বহুবার জুয়ার নেশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেও অনেকে শেষ পর্যšন্ত জুয়া খেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। আর এতে ব্যাক্তি, পারিবারিক, সামাজিক সহ বৃহত্তর পরিসরে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। ঘটে আইন শৃঙ্খলার অবনতিও । নগদ টাকা-পয়সা খুঁইয়ে জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গহনা বন্ধক, গরু-ছাগল বিক্রি, জমাজমি বিক্রি করতেও দেখা গেছে, ঘটেছে পারিবারিক বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও । অনেক সময় জুয়ার কারণে এলাকায় চুরি-ছিনতায় সহ নানা অপরাধ কার্যক্রম দেখা দেয় । যে এলাকায় জুয়া খেলা হয় সেখানকার গ্রামীন অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে । মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকে না তখন দেখা দেয় নানা বিপর্যয় ।
ঝিনাইদহ জেলায় যাত্রাপালা, সার্কাস, লটারী বা অন্যান্য উৎসব উপলক্ষেই নয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জুড়েই জুয়া খেলা হয়ে আসছিল ।
বিশেষ করে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী, শিল্পকলা একাডেমী এলাকা, হামদহ স্ট্যান্ড, আরাপপুর জামতলা, ঢোল সমুদ্র এলাকা সহ কয়েকটি স্পটে নিয়মিত জুয়া চলত । শৈলকুপা উপজেলার কবিরপুর বেবি স্ট্যান্ড, ওয়াপদাহ কলোনী, মাইক্রোস্ট্যান্ড, শেখপাড়া বাজার, চড়িয়ারবিল, তমালতলা, লাঙ্গলবাধ সহ ছোট-খাট হাটবাজার এলাকায় এই জুয়া ছিল নিত্যদিনের খেলা । কালীগঞ্জের বলিদাপাড়া, কাশিপুর বেদে পাড়া, শীবনগর, কোটচাঁদপুরের বলুহর বাসস্ট্যান্ড, কাঠালিয়া বাজার, মহেশপুরের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল, হরিনাকুন্ডর কিছু স্পটে নিয়মিত আগে জুয়া চলত স্থায়ী ভাবে । তবে এদের বেশীরভাগ এখন বন্ধ হয়ে গেছে পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে জেলা পুলিশের নানা তৎপরতায় ।
বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসব জুয়া খেলার সাথে স্থানীয় কিছু সমাজপতি, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, বড় বড় রাঘোব-বোয়াল, হোমরা-চোমড়া, সন্ত্রাসী, গ্যাংগ্রæপদের অংশ গ্রহণও দেখা যায় । অনেক সময় তারা প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে আবার সংশ্লিষ্ঠ কারো কারো হাতে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এই ভয়ানক আসক্তির খেলা-আসর চালিয়ে গেছে । তবে বর্তমানে স্বস্তির নি:শ^াস ফেলেছে ঝিনাইদহের শ্রেণী-পেশার মানুষ ।
যে জুয়া খেলা যুগের পর যুগ স্থায়ী ভাবে চলে আসছিল তা বন্ধে কিভাবে সফল হলেন ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার? এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান পিপিএম জানান, ‘স্বদিচ্ছা সবার আগে রাখতে হবে তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব । তিনি বলেন স্বদিচ্ছা, দায়িত্ববোধ আর সততার উপর দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন’ তিনি। জুয়া বন্ধ করা অনেকটা কঠিন ব্যাপার ছিল উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘জুয়াড়ীরা অনেক সময় মোবাইলে আননোন নাম্বারে অর্থের অফার, তদবির আর নানা চ্যালেঞ্জও ছুড়েছে । এদের মোকাবেলা করতে, ধড়পাকড় করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কে কখনো কখনো কঠোর অবস্থানে যেতে হয়েছে’ । পুলিশ সুপার বলেন, ঝিনাইদহের জুয়া, মাদক সহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে কাজ করতে সর্বদা সহায়তা করে আসছেন বর্তমান খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি ড.খন্দকার মহিদ উদ্দিন । তিনি বলেন জুয়া বন্ধে ব্রিটিশ আমল থেকে একটি আইন রয়েছে, সেটির প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন । প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার হিসাবে যোগ দেন হাসানুজ্জামান পিপিএম । আর যোগদানের পর থেকেই আইন- জেলার শৃঙ্খলা উন্নতির নানা চেষ্টার পাশাপাশি তিনি জুয়ার আসর বন্ধে পদক্ষেপ নেন এবং এটি বন্ধে সফল হন।