বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল একটি নাম – একটি ইতিহাস। তিনি পাবনার মেয়ে। নানা খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন। পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান। শহরের নিউমার্কেট সংলগ্ন বাড়ী। মা প্রখ্যাত রাজনীতিবীদ সেলিনা বানু। যুক্তফ্রন্টের সংসদ সদস্য। তৎকালিন অবিভক্ত ন্যাপের পাবনা জেলার সভাপতি। বাবা খন্দকার মোহাম্মদ শাজাহান। টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এমন পরিবারে জন্ম নেওয়া শিরিন বানু মিতিল ছিলেন অতি সাধারন মানুষের বন্ধু। অসাধারন এক নারী – আজন্ম যোদ্ধা।

শিরিন বানু মিতিল আমার কাছে বড় শ্রদ্ধার একজন নারী ছিলেন। বয়স আমার থেকে ২/৩ বছর বেশী হবে। রাজনীতিতে ছিলেন আদর্শের প্রতিক। আমরা ভিন্ন দল করতাম কিন্তু আদর্শগত অবস্থান ছিল কাছাকাছি। আর বয়সের মত বড় ব্যবধান ছিল রাজনৈতিক ভূমিকায়। আমি যখন স্কুল ছাত্রলীগের নেতা উনি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। ৭০/৭১ সালে কাছে থেকে দেখতাম। উনার অগ্নিঝরা ভাষন শুনতাম। অথচ কাছে থেকে দেখলেও কোনদিন কথা বলার সুযোগ হয়নি।

শিরিন বানু মিতিল তাঁর দীর্ঘ জীবনকালে পাবনা অবস্থান ছিল খুবই অল্প সময়ের। এই সল্পকালীন সময়টুকুই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কাল। পাবনার ছাত্র রাজনীতি, স্বাধীনতা যুদ্ধ শিরিন বানু মিতিলকে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গেলে তাঁর নাম বলতেই হবে। ১৯৭১ সালের ২৮ শে মার্চ পাবনায় পাকিস্তানী সেনাদের সাথে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। টানা দুইদিনের যুদ্ধে সব সৈন্যকে হত্যা করা, এপ্রিলের ১০ তারিখ পর্যন্ত্য নগরবাড়ী ঘাটে সপ্তাহব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ এসব কিছুতেই শিরিন বানু মিতিল ছিলেন অসীম সাহসী এক নারী যোদ্ধা। পূরুষের পোষাক পরে তিনি অস্ত্র হাতে সশস্ত্র যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে বিদেশী সাংবাদিকরা তাঁর সচিত্র প্রতিবেদন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করলে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তিনি যুদ্ধকালীন নয়মাস মুজিবনগর সরকারের অধীনে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি – ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীতে সক্রিয় অংশ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন।

এমন একজন মহিয়সী নারীর সাথে জীবনে প্রথম দেখা আর হাজার কথা হলো উনার মৃত্যুর কিছুদিন আগে। ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের কোন একদিন, পাবনার টাউন হল মাঠে একুশের বইমেলায়। সেদিন সন্ধ্যায় আয়োজকদের নিয়ন্ত্রন কক্ষে শিরিন বানু মিতিল একাকী বসে আছেন। তাঁকে সালাম দিয়ে কাছে বসে আমার পরিচয় দিলাম। বললাম আমি পাবনা জেলা জাসদের সভাপতি। আমার পারিবারিক পরিচয় দিলাম। তাঁর চাচা এনামুল করিম শহীদ ( জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) আমার খুব ঘনিষ্ট। একসাথে দীর্ঘদিন আমরা জেলে ছিলাম। আমার বড় ভাই ( মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম রবি) এর কথা বললাম। পরিশেষে আমার বড় মেয়ের শ্বশুর সিরাজগঞ্জের প্রখ্যাত রাজনীতিক সাইফুল ভাইয়ের কথা বলতেই নড়েচড়ে বসলেন। দূরে বসা মিতিল আপা যেন মুহুর্তেই আপন হয়ে গেলেন। প্রথমেই বললেন, আমি আপনার মেয়ের বিয়েতে ছিলামতো। স্মৃতিচারন করলেন সাইফুল ভাইকে নিয়ে। মুহুর্তেই যেন হাজার কথা শেষ হয়ে গেল। আমাকে বার বার আপনি বলায় একাধিকবার বললাম তুমি করে বলেন। উনি বললেন আপনি বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কটা যে অনেক বড়। সেদিনের দীর্ঘ সময়ের আলোচনায় উনার মা সেলিনা বানুর স্মৃতি স্মারকগ্রন্থের কথা বললেন। আমিও উনাকে বার বার বললাম আপা আপনার বেশী বেশী পাবনা আসার দরকার। আপনাদের মূল শিকড়তো এই পাবনায়। এই পাবনা আপনাকে এবং আপনার মাকে বিখ্যাত করেছেন। অথচ এই পাবনার সাথে আপনাদের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আজকের প্রজন্ম আপনাদের চিনেনা – জানেনা। আমি মনে করি জীবন সায়াহ্ণে আপনার পাবনায় ঘন ঘন আসা দরকার। উনি আমার কথা শুনে নীরব সম্মতি দিলেন। হাসলেন এবং বললেন ইচ্ছে হয় কিন্তু হয়ে উঠেনা। কেমন যেন আটকা পড়ে গেছি।

সেদিন অনেক কথা বলে মিতিল আপা বিদায় নিলেন। এর কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ২১ শে জুলাই আমাদের মাঝ থেকে চীরদিনের মত হারিয়ে গেলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরন করলেন। শিরিন বানু মিতিল কুমিল্লায় তাঁর স্বামীর দেশে অন্তিম শয়নে শায়িত আছেন। এই ক্ষনজন্মা নারী পৃথিবীতে রেখে গেছেন জীবনকর্মের কিছু স্মৃতি – যা ইতিহাস হয়ে অমলিন থাকবে তাঁর জীবনকালের বেশী সময়।
——– সমাপ্ত ——

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।