দার্জিলিং ভ্রমন


। আমিরুল ইসলাম রাঙা।

দার্জিলিং নিয়ে কৌতুহল সেই ছোটবেলা থেকে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা পর্যটন শহর। মাটি থেকে ১০ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত। অদ্ভুত আবহাওয়া আর প্রচন্ড ঠান্ডা। শহরের যেকোন প্রান্তে দাড়িয়ে এভারেষ্ট পর্বতের চুড়া এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয় পর্বতমালার পুরাটাই দেখা যায়। সেখানকার আরেকটি আকর্ষন হলো ভোরের সূর্যোদয় দেখা। আমাদের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়ে প্রবাদ আছে -সেখানে গাছে উঠলেই হিমালয় পর্বতমালা দেখা যায়। শীতের শুরুতে পঞ্চগড় জেলার বেশ কিছু এলাকা থেকে খালি চোখে হিমালয় পর্বতমালা দেখা যায়। একবার ঢাকা থেকে বিমানে সৈয়দপুর যাবার সময় ঘোষনা করে যাত্রীদের হিমালয় পর্বতমালা দেখানো হয়েছিল । সেদিন বিমান থেকে উত্তরে সাদা বরফের পর্বত দেখে পুলকিত হয়েছিলাম।

অনেক বছর পর একদিন ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত হলো দার্জিলিং যাবো। দুইদিনের প্রস্তুতিতে দুইজন সফরসঙ্গী নিয়ে দার্জিলিং ভ্রমনের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হলো। সফরসঙ্গীরা হলেন ঢাকার ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী ফজলু ও শাজাহান ভাই । ফজলু হলো পাবনার প্যারাডাইস সুইটস্ এর মালিক ইব্রাহিম ভাইয়ের শ্যালক। একদিনের মধ্যে ভিসা সংগ্রহ করা হলো। সব প্রস্তুতি শেষ করে পরেরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ঢাকার গাবতলী থেকে বুড়িমারীগামী নৈশকোচে রওয়ানা দিয়ে খুব সকালে বর্ডারে পৌছালাম। এপাড়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে সকাল দশটার মধ্যে বর্ডার পার হলাম। ওপারে কুচবিহার জেলার চেংড়াবান্ধা। সেখান থেকে পাঁচ টাকার গাড়ী ভাড়ায় পৌছালাম জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি থানা শহরে। সেখানে আমার এবং ফজলু ভাইয়ের পুরানো বন্ধু মানিক থাকে। মানিকের জন্মস্থান পাবনার শালগাড়ীয়ায়। ময়নাগুড়িতে আমার দ্বিতীয় সফর। বাসষ্ট্যান্ডে নেমে পূর্ব পরিচিত বিমলদার রেষ্টুরেন্টে গেলাম। বিমলদা আমাদের দেখেতো অবাক। দ্রুত সংবাদ দিয়ে মানিককে ডেকে আনা হলো। মানিক আমাকে আর ফজলু ভাইকে দেখে মহাখুশী। এরপর কয়েকঘন্টা ময়নাগুড়ি কাটিয়ে মানিককে সাথে করে জলপাইগুড়ি শহরে গেলাম। সেখানে একটি হোটেলে উঠলাম। ফ্রেস হয়ে জলপাইগুড়ি শহর ঘুরলাম।শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি দেখলাম। বিশেষ করে বিকালে শহরের পুর্ব পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী দেখলাম। রাতে হোটেলে এসে খাওয়া করে শুয়ে পড়লাম।

পরেরদিন সকালে উঠে নাস্তা করার পর আমরা শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি দুইঘন্টার কম সময়ের রাস্তা। শিলিগুড়ি যাবার পথে বাংলাদেশ বর্ডার দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে সীমান্তের টাওয়ারগুলি দেখেই বুঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছি। শিলিগুড়ি বিশাল শহর। পশ্চিম বাংলায় কলকাতার পরে দ্বিতীয় বৃহতম শহর। অথচ শিলিগুড়ি হলো দার্জিলিং জেলার একটি মহকুমা। শিলিগুড়ি শহরের দক্ষিন সংলগ্ন বাংলাদেশ বর্ডার এবং পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া অবস্থিত। পশ্চিমে ১০/১২ মাইলের মধ্যে নেপাল বর্ডার, উত্তর পাশে আকাশ ছোয়া কালো পাহাড় এবং দার্জিলিং জেলা শহর।।পুর্বে জলপাইগুড়ি জেলা। আমরা শিলিগুড়িতে দুইদিন ছিলাম। দুইদিনে শহরের আকর্ষনীয় স্থানসমুহ দেখলাম। এরমধ্যে আকর্ষনীয় একটি স্থান হলো সেবক। শিলিগুড়ি শহরের উত্তর পুর্বে অবস্থিত সেবক হলো সিকিম বর্ডার সংলগ্ন।সেখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো দুই পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত সেতু। দুইদিনে শিলিগুড়ি শহরে অনেক মজার মজার ঘটনাও ঘটেছে। একদিন দল ধরে আমরা চারজন শিলিগুড়ি বাস টার্মিনালে বেড়াচ্ছি। ওখান থেকে কাঠমুন্ডু, সিকিম, কলকাতার সরাসরি বাস সার্ভিস সমন্ধে ধারনা নিচ্ছি। কোথায় কত ভাড়া – কত কিলোমিটার – কত সময় লাগে – ইত্যাদি। আমাদের আরো একটি ধারনা নেওয়া প্রয়োজন সেটা হলো দার্জিলিং যাওয়ার পরিবহন সম্পর্কে জানা। মজার ঘটনা ঘটলো তখন। একজন অপরিচিত যুবক এসে আমাকে বলছে আপনি রাঙা ভাই? আমি বললাম আপনি কে? সে যেটা বললো তাতে শরম পাওয়ার মত। সে বললো ভাই আমার বাড়ী পাবনার রাধানগর এলাকায় আপনার পাড়ায়। আমি আপনার ছোট ভাইয়েরও ছোট। তারমানে আপনি বলাতো দুরের কথা তুই তুমি বলতে হবে। সে বললো বেশ কয়েক বছর হলো পাবনা থেকে একবারে চলে এসেছে। শিলিগুড়িতে বাস পরিবহনের শ্রমিক। তারপর ওকে সাথে নিয়ে দার্জিলিং যাবার জীপ গাড়ী রিজার্ভ করার ধারনা নিলাম। ওর মাধ্যমে পাবনা থেকে যাওয়া আরো কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। বিশেষ করে সেবক রোডে দেখা হলো পাবনার বাসস্ট্যান্ডের উপর হোটেল ছিল ভগবান সাহা তার ছেলের সাথে। সেও ওখানে খাবার হোটেল দিয়েছে। পাবনার পুরাতন লোকজনের কাছে ফজলু ভাই খুব পরিচিত। কারন হলো স্বাধীনের পর থেকে ফজলু ভাই পাবনার প্যারাডাইস মিষ্টির দোকানে ক্যাশটেবিলে বসতো।

পরেরদিন আমাদের যাত্রা সেই স্বপ্নের শহর দার্জিলিং। শিলিগুড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটারের মত দুরত্ব। সেখানে ট্রয় ট্রেন অথবা জীপ দুই ভাবে যাওয়া যায়। আমরা একটা জিপগাড়ী রিজার্ভ করে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাত্রার দশ মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে উঠা শুরু হলো। কিছুক্ষনের মধ্যে ভিন্নতা আঁচ করতে শুরু করলাম। প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো কান বন্ধ হয়ে গেল (ধাপা ধরা)। আস্তে আস্তে আবহাওয়া পরিবর্তন হতে থাকলো । কিছুক্ষণ আগে শিলিগুড়িতে গরমের কারনে ফ্যান চালাতে হয়েছে। আর এখন মনে হচ্ছে শীতের রাজ্যে ঢুকে পরেছি। ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে আমাদের পোষাকও পরিবর্তন হতে থাকলো। গাড়ীর মধ্যেই শীতবস্ত্র পরা শুরু হলো। মাটী থেকে কয়েক হাজার ফুট উঠতেই কান বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু চোখটা ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। কারন হলো অচেনা অপরুপ সৌন্দর্য্যতায় ক্রমেই মুগ্ধ হয়ে পড়ছি। এক সময় গাড়ী এসে থামলো আরেক মহকুমা শহর কালিংম্পং। সেখানে অল্প সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি দেওয়া হলো। অল্প সময়ে শহরটাকে যথাসামান্য দেখলাম। আর ঐ সময়টুকুর মাঝে কয়েক কাপ গরম চা খেয়ে গা গরম করার চেষ্টা করলাম। বিরতি শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা –সাথে বেড়ে যাচ্ছে পরিবর্তনের মাত্রা।

একপর্যায়ে দার্জিলিং শহরে পৌঁছে গেলাম । দুপুর বেলায় শহর মনে হচ্ছে ঘোলা!! চারিদিকে মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে !! ঘন কুয়াশার মত মেঘ ঢুকে পড়ছে শহরের মধ্যে। আবহাওয়ার কথা বলতে হলে প্রথম বলতে হবে প্রচন্ড ঠান্ডার কথা। আমরা এমন ঠান্ডা জীবনে দেখি নাই। মানুষ কথা বলছে, মুখ দিয়ে ধুয়া বের হচ্ছে। প্রথমতো গাড়ী থেকে নামতেই আপত্তি করলাম। গাড়ীতে বসেই হোটেল খোঁজা হচ্ছে। বিশ্বের সেরা পর্যটন শহর। শহর জুড়ে হোটেল আর হোটেল। সব ধরনের হোটেল আছে। পঞ্চাশ টাকা থেকে হাজার টাকার রুম আছে। এখানে ধনীদের জন্যে তারকা খচিত হোটেল আছে। আমরা উঠলাম -মানসম্মত এক মাঝারী মানের হোটেলে। থাকা, খাওয়া তুলনামুলক অনেক সস্তা। মুসলিম হোটেল আছে। বাঙালীর হোটেল আছে। ডাল ভাত, সবজি, মাছ মাংস সব পাওয়া যায়। চাইলে গরুর মাংস পাওয়া যাবে।

অদ্ভূত শহর দার্জিলিং। পাহাড়ের গা কেটে গড়ে উঠা এই শহরে হোটেল, দোকানপাট, বাড়ীঘর, অফিস আদালত, পার্ক ,খেলার মাঠ, চিড়িয়াখানা সবই আছে। শহরের উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ পাঁচ পর্বত (হিমালয় পর্বতমালা),। ২৯ হাজার ফুট উচ্চতার পর্বতের গোড়া থেকে আকাশছোয়া মাথা দেখা যায়। ভারত, চীন, নেপাল এবং ভূটান এই চার দেশের উপর হিমালয় পর্বতমালা অবস্থিত। আর উত্তর -পশ্চিমে নেপাল এবং চীনের উপর অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার এভারেষ্ট পর্বত। দার্জিলিং থেকে এভারেষ্ট পর্বতের উপরিভাগ খালি চোখে দেখা যায়। দেখলে মনে হবে ১০ কিলো দুরত্ব। শহরের কিছু জায়গায় বড় বাইনোকুলারে পাঁচটাকা দিয়ে চোখের সামনে পর্বতকে হাজির করা যায়। এই শহরে স্থায়ী বাসিন্দা বেশীর ভাগ নেপালী বংশভুত গুর্খা। আর শহর জুড়ে পৃথিবীর সব দেশের সব রংয়ের হরেক চেহারার মানুষ দেখা যায়।

এই শহরে ভ্রমনকারীদের কাছে অন্যতম আকর্ষন ভোরের সুর্যোদয় দেখা। রাতেই হোটেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করলেন। রাত তিনটার দিকে এক বিশেষ জীপগাড়িতে আমাদের তোলা হলো। গন্তব্য আরো আড়াই হাজার ফুট উপরে টাইগার হিলে। শত শত গাড়ী আর কয়েক হাজার পর্যটক। সেখানে সুর্যোদয় দেখা যাবে পাদদেশে সুর্য্য দেখার অনেক আগে। সবাই পূর্বাকাশে তাকিয়ে আছে। চারিদিকে অন্ধকার। পূর্বাকাশে আস্তে আস্তে আলো ফুটছে আর উত্তরের হিমালয় পর্বত রং বদলাচ্ছে। আলোর ঝিলিকে হিমালয়ের সাদা বরফের পাহাড়কে সোনার পাহাড় (সংযুক্ত ছবি) মনে হচ্ছে। এরপর পূর্বাকাশে অগ্নিমশাল উদয় হয়ে সেটা গোল হয়ে সূর্যের আকৃতি নিতে বেশ সময় পার হলো। শেষ হলো সুর্যোদয় দেখা। সূর্যোদয় দেখে ফিরে আসার পথে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দেখানো হলো। হোটেলে ফিরলাম সকাল আটটার দিকে। আমাদের কপাল ভাল বলে প্রথম রাতেই সুর্যোদয় দেখলাম। কথিত আছে কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বহুবার এসে ও মেঘলা আকাশের জন্য সুর্যোদয় দেখতে পারেন নাই। তারপর আরো দুইদিন সেখানে কাটিয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখলাম।

তারপর দার্জিলিং থেকে একই পথে শিলিগুড়ি ফিরলাম। সেখান থেকে জলপাইগুড়ি ফিরে এলাম। দুইদিন মানিক এবং তার বন্ধুদের সাথে জলপাইগুড়ির দর্শনীয় স্থান গুলি দেখলাম। বিশেষ করে ময়নাগুড়ি, মালবাজার, সামচিং এর ডুয়ার্স এলাকা দেখলাম। সামচিং এর চা বাগান -কমলা বাগান গুলি দেখলাম। দার্জিলিং ভ্রমনে এসে বোনাস সুযোগ হলো ভুটানের বড় শহর ফুলসিলিং যাওয়ার। ভারতীয়দের পাসপোর্ট ভিসা লাগেনা। দুইঘন্টার কম সময়ের পথ। যথারীতি জলপাইগুড়ি থেকে ভারতীয় বন্ধুদের সাথে আলীপুরদুয়ার হয়ে জয়গাঁ সীমান্তে পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে ভুটান গেট পার হয়ে ফুলসিলিং শহরে ঢুকলাম। ভুটানের বানিজ্যিক ও পর্যটন শহর। সমতল ভূমিতে অবস্থিত শহরটি বেশ বড়। হোটেল, বার আর মার্কেট বেশী। ফলের মার্কেট বেশ বড়। এখান থেকেই বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে ফলমূল রফতানী হয়। সারাদিন সেই শহর ঘুরে ফিরে দেখলাম। দুপুরে একটা মানসম্মত হোটেলে খেলাম। তারপর সন্ধ্যার আগে ভুটান থেকে বের হয়ে জয়গাঁ থেকে বাসে উঠলাম। রাত আটটার দিকে জলপাইগুড়ি ফেরত এলাম। তারপর জলপাইগুড়িতে এসে রাতের খাবার খেলাম। আমরা জলপাইগুড়িতে একটি গেষ্ট হাউসে ছিলাম। মজার ব্যাপার হলো নাস্তা সহ দুপুর রাতের খাবার অর্ডার দিলে মালিকের বাসা থেকে রান্না করা খাবার দেওয়া হতো । সুবিধা হলো, খাবারগুলি টাটকা, গরম এবং সুস্বাদু রান্না। সাশ্রয়ী মূল্যে বাড়ীর খাবার পাওয়া যেত । যাইহোক বিদায়ী রাতের অবস্থান হলো বড় মজার এবং আনন্দের। বলা যায় বিনোদনের মধ্যে দিয়ে বিনিদ্র রজনী শেষ হলো। পরেরদিন জলপাইগুড়ি থেকে সকালে মানিক সহ চেংড়াবান্ধা বর্ডারে এলাম। কাষ্টমের কাজ শেষ করে বেলা ১১ টার দিকে বুড়িমারী এলাম। সেখানে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে বেলা ১২ টার কোচে রওয়ানা হলাম। পাটগ্রাম – লালমনিরহাট – রংপুর হয়ে যথারীতি ঢাকা ফিরে এলাম। স্বপ্ন দেখার মত শেষ হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ এক আনন্দ ভ্রমন।
। সমাপ্ত।

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।