মোঘল সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে যেমন
নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল তেমনি একজন চিকিৎসক স্ত্রীর প্রতি
ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছেন \’মোহিনী তাজ\’।
ঠাকুরগাঁও জেলার
আখাঁনগর ইউনিয়নের চতুরাখোর গ্রামের মাধবীকুঞ্জে দৃষ্টিনন্দন এ মোহিনী তাজ
ভবন নির্মাণ করেন চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল। আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ার ও
ডিজাইনারের ভূমিকা পালন করে এ দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজ নির্মাণ করেন চিকিৎসক
ফিরোজ।
নিজের স্বপ্ন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, নারী জাতির প্রতি
শ্রদ্ধা ও স্ত্রীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসাকে উৎসাহ ও সাহস হিসেবে নিয়েই
মোহিনী তাজ নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি।তাই তো চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল
তার দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজকে নিয়ে ছন্দে ছন্দে লিখেছেন-
\’গগনবিদারী ভুবন রাজ,
মাধবীকুঞ্জে মোহিনী তাজ।
শিল্পশৈলী কারুকাজ,
দিগ্বিজয়ী মোহিনী তাজ।\’
চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল শুধু একজন চিকিৎসকই নয়, তিনি কবি, আর্কিটেকচার,
ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনারও বটে। ইতোমধ্যে তিনি রচনা করেছেন \’স্বপ্নের
প্রাবন্ধিক কাব্য\’ ও \’চিঠিহীন খাম\’ নামের দুটি কবিতার বই।
গত বছরের
২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে
মোহিনী তাজ। অবসর সময় কাটানোর জন্য ও দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজ দেখার জন্য
প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী ভিড় জমান। দর্শনার্থীরা মোহিনী তাজ দেখে এর
কারুকাজকে শিল্পকর্ম বলে অভিহিত করেন।মোহিনী তাজের মালিক চিকিৎসক ফিরোজ
জামান জুয়েল পেশায় একজন চিকিৎসক। তার স্ত্রী জেসমিন রহিমও একজন চিকিৎসক।
মোহিনী তাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েলের সঙ্গে কথা বলেন ।
কেন এই ভবনের নাম \’মোহিনী তাজ\’ দেয়া হল জানতে চাইলে চিকিৎসক ফিরোজ জামান
বলেন, মোহিনী শব্দের অর্থ আকর্ষণীয়, মোহমীয়, আবেদনপূর্ণ ও মমতাময়ী। আর তাজ
অর্থ সেরা, শীর্ষতম বা সর্বগুণে গুণান্বিত। মোহিনী তাজ আমি উৎসর্গ করেছি
আমার প্রিয়তম স্ত্রী চিকিৎসক জেসমিন রহিমকে। সেই সঙ্গে আমার পরিবারের
নারীদের যেমন আমার মা, বোন ও অন্য নারীদের। তাই সার্বিক অর্থে সমগ্র
নারীকুলের প্রতি সম্মান জানাতে এ নামকরণ করা হয় মোহিনী তাজ।মোহিনী তাজ দূর
থেকে দেখে মনে হবে তিনতলা বাড়ি। কিন্তু চিকিৎসক জুয়েলের কাছে এটা একটা
ভাস্কর্য শিল্প। মোহিনী তাজের কারুকাজ ও ডিজাইনের মাধ্যমে জুয়েল তুলে
ধরেছেন তার জীবনের ইতিহাস, জীবনের গুরত্বপূর্ণ কিছু সময়, জীবনদর্শন,
পরিবার, দেশ ও মানুষের মননশীলতা। পৃথিবীর কিছু মৌলিক উপকরণ যেমন জল-স্থল,
সূর্য, চাঁদ, তাঁরা, সাত আসমান ও রংধনু দিয়ে ভবনের শৈল্পিক কারুকাজ করা
হয়েছে।
প্রথম দিকে জুয়েল ইন্টারনেট থেকে কয়েক হাজার বাংলোর ছবি ডাউনলোড
করে দেখেছেন। কিন্তু কোনটি তার মনমতো হয়নি। অবশেষে নিজের কল্পনা শক্তিকে
কাজে লাগিয়ে আঁকতে শুরু করেন ডিজাইন। পরে সেই ডিজাইনকে বাস্তবে রূপ দিতে
কাজ শুরু করেন। তারই স্বপ্নের বাস্তব রূপ এই মোহিনী তাজ।
মোহিনী তাজ
নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক জুয়েল বলেন, আমার বিয়ের ১২ বছর চলে
গেলে আমি বাবা হতে না পারায় এবং আর কোনোদিন বাবা হতে পারব কিনা এ নিয়ে
মানুষের মুখে চলছিল গুঞ্জন।একদিন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের এমারজেন্সিতে
নাইট ডিউটি করার সময় অল্প ঘুমের মাঝে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। তিন মাস
পর আকস্মিকভাবে জানতে পারলাম আমি বাবা হচ্ছি। তখন সেইদিন স্বপ্নে একটি ঘর
দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখা ঘরটি হচ্ছে এই মোহিনী তাজ।
মোহিনী তাজ তৈরিতে
স্ত্রী জেসমিন রহিমের কেমন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে জুয়েল
বলেন, জেসমিন শুধু আমার স্ত্রী এটুকু বললে ভুল হবে। আজ তারই অনুপ্রেরণা
আমি। আমার প্রতিটি কাজে তার অনু্প্রেরণা রয়েছে। আমাদের স্বপ্নের মোহিনী তাজ
একসময় নিদর্শন হয়ে থাকবে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে।
মোহিনী তাজের
ডিজাইন সম্পর্কে ফিরোজ জামান জুয়েল বলেন, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ চার হাজার
মাইলের পরিবর্তে ৪০ ফুট ব্যাসার্ধে বৃত্ত আঁকা হয়েছে এটি। পৃথিবীর নকশা,
প্রণয়ন, বিন্যাস, সাজসজ্জা, সমন্বয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছি।
বৃত্তের মাঝে জল ও স্থলের মোটামুটি আনুপাতিকহারে মূল ভবনের চারপাশে জলকে
দেখিয়েছি নদীর আকারে। আর স্থলকে চিহ্নিত করেছি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের
ছায়ার আদলে। দুটি বলের ওপরে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে
যে ছায়া তৈরি হয় সেই ছায়ার আদলে কাটা হয়েছে ঘরের মেঝে।তিনি আরও বলেন, দুটি
বলের ওপর দণ্ডায়মান দৃশ্যটি কল্পনা করা হয়েছে। এটি স্মরণ করার জন্য মানুষ
যেমন দুটি বলের ওপর দীর্ঘস্থায়ী হয়ে দাঁড়াাতে পারে না তেমনি ক্ষণস্থায়ী
মানুষের জীবন। এ মানুষ থেকে পরিবার যা দেশের ক্ষুদ্র একক। সে পরিবারকে
পূর্বদিকে সম্মুখভাগ থেকে দেখলে মনে হবে যে সামনের দুটি সন্তানকে মা যেন
ডানা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন, আর বাবা যেন ঠিক তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তর
দিক থেকে দেখলে মনে হবে বাবা-মা মাঝখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আর দুই পাশে দুই
সন্তান। যা হেলমেটের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। সেই পরিবার থেকে দেশ যা ঘরের
চারপাশে জলের মাঝে লাল সূর্য ও তার চারপাশে সবুজের আদলে করা হয়েছে। মোহিনী
তাজের ভেতরের প্রতিটি তলায় দেখলে মনে হবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদ, তারা
আর রংধনুর মিশ্রন। মোহিনী তাজ মোট ১৩টি স্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে
শিল্পী তার পরিবারের ১৩ জন ভাই-বোনকে উদ্দেশ্য করেছেন। প্রতিটি জানালা ও
তার বাইরের কারুকাজ লাল, হলুদ নীল রঙের সমন্বয় করা হয়েছে সূর্য, চাঁদ ও
তারার আদলে।
মোহিনী তাজের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার
জন্য চিকিৎসক জুয়েল এখানে ব্যবস্থা করেছেন কমিউনিটি সেন্টার, শিশুদের
বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পটের। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে
মুখরিত হয়ে থাকে মোহিনী তাজ।