পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক আমজাদ হোসেন

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
আমজাদ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাবনা সদর, আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এম,এন,এ) নির্বাচিত হন। আমজাদ হোসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত বৃহত্তর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এর আগে ১৯৬২ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এম,এন,এ) নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আমজাদ হোসেন ১৯২৪ সালে পাশ্ববর্তী কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় চর সদিরাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা রফিক উদ্দিন মাতা পরিজান নেছা। বাল্যকালেই পিতামাতার সাথে জন্মস্থান ছেড়ে পাবনা শহরের উপকন্ঠে নূরপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। প্রথমে মক্তব পরে পাবনা জেলা স্কুল। মাধ্যমিক শেষ করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কলকাতায় মাওলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ভর্তি হবার পরই হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর দৃষ্টিতে পড়ে যান। সেখান থেকেই রাজনীতির শুরু। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পি,এস হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রায় ৬ মাস ঐ পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যায়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেন। এর বিরুপ প্রভাব পড়ে পাবনা অঞ্চলে। এই অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতারা ন্যাপে যোগদান করলে আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব সঙ্কট দেখা দেয়। এমনি সময়ে আমজাদ হোসেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহন করেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলার মাঝেই আমজাদ হোসেনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলি গড়ে উঠতে থাকে। যার সুফল ১৯৬২ সালের নির্বাচনে পাওয়া যায়। সেই নির্বাচনে আমজাদ হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য ( এম,এন,এ) নির্বাচিত হন।

এরপরে ৬২ এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ফাতেমা জিন্নার পক্ষে নির্বাচন, ৬৬ এর বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষনা, একপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার, ৬৭ তে পাবনায় সংঘটিত ভূট্টা আন্দোলন, ৬৮/৬৯ এর গন আন্দোলন, ৭০ নির্বাচন এসব কিছুতেই আমজাদ হোসেন সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাবনার সকল আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হন। তারপরের ইতিহাস হলো ভিন্ন। ৭০ এর নির্বাচনের কয়েকদিন পর ২২ ডিসেম্বর সাঁথিয়া-বেড়া থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এম,পি,এ) আহমেদ রফিককে নক্সালরা পাবনা শহরের রাঘবপুরের বাসার সামনে ছুরিকাঘাত করে খুন করেন। এরপর মার্চ থেকে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষনের পর পাবনায় গঠন হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ। নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি হন আমজাদ হোসেন, সদস্য ছিলেন, আব্দুর রব বগা মিয়া ( এম,পি,এ), এডভোকেট আমিন উদ্দিন ( এম,পি,এ), আমিনুল ইসলাম বাদশা ( ন্যাপ নেতা), গোলাম আলী কাদেরী ( আওয়ামী লীগ নেতা), দেওয়ান মাহবুবুল হক ফেরু মিয়া ( আওয়ামী লীগ নেতা) আব্দুস সাত্তার লালু ( ছাত্রলীগ নেতা), নুরুল কাদের খান ( জেলা প্রশাসক) এবং আব্দুল গাফফার ( পুলিশ সুপার)। বর্নিত কমিটি ২৬ মার্চ পর্যন্ত হরতাল, মিছিল, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ সহ সমস্ত সরকারী – বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী চলে তার প্রচারণা সহ পাড়া মহল্লায় যুব তরুনদের সংগঠিত করে সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহনের নির্দেশনা চালাতে থাকে।

২৬ মার্চ পাবনাবাসী দেখলো শহরে পাকিস্তানী সৈন্য। ভোর থেকে শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্ফু আইন জারী করা হয়েছে। ঘর থেকে কাউকে বের না হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। আগের রাতেই সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিনকে ধরে নিয়ে বিসিক এলাকায় সেনা ক্যাম্পে নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করে। ২৮ এবং ২৯ মার্চ পাবনার বীর জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ করে এখানে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করে পাবনা শহরকে মুক্ত করে। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা মুক্ত থাকে। এরমাঝে ৬ এপ্রিল কোন এক সময় আমজাদ হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। নীরবেই তিনি চীরবিদায় নিলেন।

দুর্ভাগ্য উনার – আর কয়েকমাস বাঁচতে পারলে স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারতেন। বেঁচে থাকলে পাবনার রাজনীতি – পাবনার নেতৃত্ব উনিই দিতেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি উনি বঙ্গবন্ধু সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হতেন। দুর্ভাগ্য উনার – যদি অমন সময়ে অমন করে মারা না গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে মারা যেতেন তাহলে শহীদ আমজাদ হোসেন বলে সবাই স্মরণ করতে পারতেন !!!? স্বাধীনতার পর প্রথম উনাকে স্মরণ করেছিলেন পাবনার মটর শ্রমিকরা। মধ্য শহরে বাসষ্ট্যান্ডে মটর শ্রমিকরা অফিস বানিয়ে সেটার নাম দিয়েছিলো ” আমজাদ স্মরনীকা “। এরপর শহরের বাইরে বালিয়াহালট গোরস্থানের পূর্বপাশে স্থানীয় জনগন প্রতিষ্ঠিত করেছেন ” আমজাদ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় “। এরপর আর নাই !!! যা ছিল তাও ধ্বংশ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে !!! মটর শ্রমিকদের সেই ” আমজাদ স্মরনিকা ” ভবনটি গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের অফিস বানানো হয়েছে। আর একটি সম্পদকে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যা গভীর ভাবে ভাবতে গেলে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আর সেই জঘন্য অপরাধটি করেছে তাঁর পরিবারের সদস্যরা। আবার বলতে হবে উনি দুর্ভাগা হয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র ছেলে অপরিনত বয়সে অকাল মৃত্যুবরণ করেন। মেয়েদের বিয়ে হয়েছিল এই শহরে ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদের সাথে। আজ প্রচন্ড ঘৃনায় তাদের নাম লিখলাম না। তারা কিছুদিন আগে পাবনা পৌরসভার সাথে আমজাদ হোসেনের ঐতিহাসিক বাড়ীটি গুড়িয়ে দিয়ে ছোট ছোট প্রাচীর করে জায়গা ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁরা কি জানতো এই বাড়ীর মধ্যে কত বড় ইতিহাস ছিল? দৃষ্টিনন্দন সেই ডুপ্লেক্স বাড়ীটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ এদেশে সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দ অনেকবার এসেছেন? স্বাধীনতার আগে যারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন কি কেউ বলতে পারবে ঐ বাড়ীতে তাঁরা যাননি? বরং অনেকে বলবে আমি শত শতবার ঐ বাড়ীতে গেছি? ঐটাই ছিল মূলতঃ আওয়ামী লীগ রাজনীতির কন্ট্রোল রুম। এরপর ১৯৭১ সালে ৮ মার্চ পাবনায় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলে এই বাড়ীতেই প্রথম কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় । পরে পুরাতন টেকনিক্যালে কন্ট্রোল রুম স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কয়েকদিন চলার পর ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় পাকিস্তানী সেনারা প্রবেশ করলে মুক্তিকামী যোদ্ধারা পাবনা ত্যাগ করেন। কথাগুলি লিখতে পেরে নিজের মাঝে লুকিয়ে থাকা কষ্টটুকু প্রশমিত হলো। পরিশেষে বলবো যতই তাঁর স্মৃতিকে কেউ বিলীন করতে চাইবে – ততই তাঁর কথা জেগে উঠবে। পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হলে তাঁর নাম প্রথম বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি শত বছর পরও উনাকে স্মরণ করতে হবে।

( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২৮ জুলাই ২০১৮

তথ্যসুত্র –
১. রবিউল ইসলাম রবি রচিত ” পাবনা ১৯৭১ ” গ্রন্থ।
২. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান।
৩. শেখ মোহাম্মদ সুমন, তরুন গবেষক, নীলমনি গ্যালারী।