পুলিশের প্রতিবেদনেই আরেক ‘এরশাদ শিকদার’

:

দৌলতদিয়া পতিতালয়ের ভেতরে বাড়িওয়ালা লাভলী ও সালমী হত্যা, ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর মার্ডার, পলাশ মার্ডার, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র সাইফুল ইসলাম রিপন হত্যা, আপন দুই ভাই সাদ্দাম ও রুবেলকে হত্যাসহ সব ঘটনায় নুরু মণ্ডলের হাত রয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। এসব মামলার এজাহারে নুরু মণ্ডলের নাম না থাকলেও মূল কলকাঠি নুরু মণ্ডলই করে থাকেন।’

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ওরফে নুরু মণ্ডলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে এভাবেই তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এলাকার মানুষের কাছে তিনি খুলনার সেই ‘এরশাদ শিকদার’-এর চেয়েও ভয়ংকর। ২০ বছর ধরে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। অনেকে তাকে পদ্মাপরের ত্রাসও বলে থাকেন।যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন রাতারাতি তিনি সেই দলের সদস্য বনে যান। এজন্য সবসময় তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে নির্বিঘ্নে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। সরকারি দলের স্থানীয় নেতারাও তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। এভাবেই অধরা এক শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছেন এই নুরু মণ্ডল। স্থানীয় পুলিশের খাতায় তিনি সর্বহারা, খুনি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত।

২০০৮ সালের পর রাজনৈতিক তদবিরে তার নাম পুলিশের তালিকা থেকে বাদ পড়ে। তবে তার সব কর্মকাণ্ডের রেকর্ডপত্র সংরক্ষিত আছে পুলিশের অপরাধ নথিতে। রাজবাড়ী জেলা পুলিশ বলছে, নুরু মণ্ডলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে। দুর্র্ধষ এই সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে দৌলতদিয়া এলাকাজুড়ে রয়েছে নিকটাত্মীয়দের সমন্বয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, যার নেতৃত্ব দেন তিনি নিজেই।

খোদ পুলিশের গোপন প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ‘নুরু মণ্ডল একসময় দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরিওয়ালার কাজ করে জিবিকানির্বাহ করতেন। শিক্ষাজীবনে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পেরুতে পারেননি।

কালের বিবর্তন ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বর্তমানে তিনি দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের স্বঘোষিত রাজা বলে পরিচিত। ‘স্থানীয় সংসদ সদস্যের (কাজী কেরামত আলী) প্রত্যক্ষ মদদে তিনি এখন রাজনীতিবিদও। এই পরিচয়ের আড়ালে এমন কোনো কাজ নেই, যা তিনি করেন না। ঘাটের ফেরিওয়ালা থেকে ভয়ংকর সন্ত্রাসী এই নুরু মণ্ডল এখন বিপুল বিত্তবৈভবেরও মালিক।’

পুলিশ প্রতিবেদনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী মঙ্গলবার বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির খারাপ দিকের দায় আমি নেব না। খারাপ মানুষ সবসময়ই খারাপ। দোষী হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা ধরনের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।’

আপনার ছত্রছায়ায় নুরু মণ্ডল ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অভিযোগ করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘না না, এসব ঠিক না। সে তো গোয়ালন্দ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তবে কথা হচ্ছে, আমার ভাই (কাজী এরাদত) রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দলে ডিভিশন করে ফেলছে। বিষয়টি আমি নেত্রীকেও বলব।’

তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্বে (জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) থাকাকালীন ব্যালেন্স করে চলতাম। বুঝেন তো রাজনীতিতে ভালো-মন্দ নিয়েই চলতে হয়।’

গোয়ালন্দ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা হতভাগা। না হলে কি এমন একজন বিতর্কিত লোককে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করি? শেষ পর্যন্ত এমপি সাহেব (কাজী কেরামত আলী) একজন ফ্রেশ লোককে বসিয়ে দিয়ে নুরু মণ্ডলকে দৌলতদিয়া ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নৌকা প্রতীক দেয়ার সুপারিশ করেছেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানোর সুযোগ আমাদের হয়নি। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছি।’স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক ভুক্তভোগীর অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘নুরুল ইসলাম মণ্ডলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের চেয়েও ভয়ংকর। অন্তত ২২টি খুনের পেছনে রয়েছে তার হাত। ছাত্রলীগের এক নেতাকে হত্যা করে দুর্র্ধষ হয়ে উঠেন নুরু মণ্ডল। এরপর একের পর এক হত্যার পরিকল্পনা করে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন।’

ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের নির্দেশে রাজবাড়ীর পুলিশ কর্মকর্তারা সম্প্রতি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ভয়াবহ সব চিত্র তুলে ধরে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ভুক্তভোগী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরু মণ্ডলের কার্যকলাপ দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত আবেদন করেন।

আবেদনটি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয় পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে। ৩০ এপ্রিল আইজিপির দফতরে ৩২৪১ নম্বরে ডায়েরিভুক্ত করে পাঠানো হয় রাজবাড়ী পুলিশ সুপারের কাছে। পুলিশ সুপার ২০ জুন রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম পিপিএম নুরু মণ্ডলের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেন। ২৬ জুন তিনি রাজবাড়ীর এসপিকে এ বিষয়ে জমা দেয়া লিখিত প্রতিবেদনে নুরু মণ্ডলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ভয়াবহ সব তথ্য উপস্থাপন করেন।

এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ভয়ংকর এই সন্ত্রাসীর অতীত কার্যকলাপসহ পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিবেদন পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়। নুরু মণ্ডল ও তার বাহিনীর সদস্যরা যে সিরিয়াল কিলার, তার অন্তত ১০টি বর্ণনা দিয়ে পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দৌলতদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোলাপ বেপারী।

তার একমাত্র ছেলে রেজাউল করিম জুলহাস দৌলতদিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় প্রথমে তাকে অপহরণ করা হয়। পরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০০৬ সালের ৪ জুন নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে গোয়ালন্দ থানায় হত্যা মামলা করা হয়। ২০০৭ সালের ২০ জুন এ মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ ঘটনার পর প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা গোলাপ বেপারী ও তার স্ত্রী ছেলের শোকে মারা যান। এরপর মামলাটির হাল ধরার মতো কেউ ছিল না। একপর্যায়ে ওই ঘটনার সাক্ষীরা জীবনের ভয়ে নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতেও যাননি। এভাবেই একদিন ছাত্রলীগ নেতা জুলহাস হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতিও পেয়ে যান নুরু মণ্ডল।

ক্যাডারদের কিলিং মিশন

ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিম জুলহাস হত্যাকাণ্ডের পর নুরু মণ্ডলের ক্যাডারদের আমলনামায় আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য দেয়া হয় পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে।

বলা হয়, ‘২০১৫ সালে পলাশ নামে একজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে ওই বছরের ২২ এপ্রিল গোয়ালন্দ থানায় হত্যা মামলা করা হয়। মামলা নং-১০। আসামিদের তালিকা উল্লেখ করে বলা হয়, নুরু মণ্ডলের ক্যাডার জিন্দার, জব্বার, আতিয়ার, নান্নু, জহুরুল, পাষাণ, আউয়াল ও মারফতের বিরুদ্ধে আদালতে পলাশ হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়।’২০১৫ সালে গোয়ালন্দ পৌর ছাত্রলীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলমকে কুপিয়ে হত্যা করে নুরু মণ্ডলের ক্যাডাররা। পৌর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটনানোর কথা বলা হয়েছে পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে।

একই সময় গোয়ালন্দ উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি তুহিন দেওয়ানকেও কুপিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৭ জুলাই একটি হত্যা মামলা করা হয়। গোয়ালন্দ থানার মামলা নং-১৩।

গোপন প্রতিবেদনে নুরু মণ্ডলের ক্যাডার পরিচয়ে যাদের আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- আকাশ, নয়ন, শান্ত, আনোয়ার, রঞ্জু, সেন্টু, মঞ্জুরুল, সাইফুল, সুজন, লুৎফর ও হালিম। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ এই ক্যাডারদের মধ্যে হালিমকে বাদ দিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর হত্যা মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়ালন্দ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তুহিন দেওয়ান বলেন, ‘আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও জাহাঙ্গীর ওই ঘটনায় মারা যায়। জাহাঙ্গীর হত্যা মামলায় আমি আদালতে সাক্ষী দিয়েছি।’

২০১৪ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র সাইফুল ইসলাম রিপনকে। ছুটিতে বাড়িতে এলে নুরু মণ্ডলের ক্যাডাররা রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর কল্পনা বাড়িওয়ালার গেটের সামনে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।

নুরু মণ্ডলের ক্যাডার পরিচয়ে হত্যাকারীদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, নুরুর আপন দুই খালাতো ভাই আশরাফ ও শহিদ ছাড়াও জামাল পত্তনদার ওরফে কিলার জামাল, ইয়াবা ব্যবসায়ী তমছের, ইয়াসিন শেখ, আমজাদ প্রামাণিক, আসাদ, ইউসুফ, সুজন, রাকিব উদ্দিন, শমসের আলী শেখ এ ঘটনায় জড়িত।

এ সময় ফরিদ নামে একজন কিলার জামালকে অস্ত্রসহ জাপটে ধরে ফেললে তাকেও গুলি করা হয়। তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনায় ওই বছরের (২০১৪) ৮ সেপ্টেম্বর গোয়ালন্দ থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। প্রায় তিন বছর পর দীর্ঘ তদন্ত শেষে এসব কিলারের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়।

রিপন হত্যা মামলার চার্জশিটের এক স্থানে বলা হয়, ‘আসামি জামাল পত্তনদার, তমসের, আশরাফ, হারুন ও ইয়াসিনের বিরুদ্ধে গোয়ালন্দ থানায় ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, নারী নির্যাতন এবং নারী পাচারের মামলা আছে। মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন।

এসব সন্ত্রাসী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (চার্জশিটকালীন নুরু মণ্ডল দৌলতদিয়া ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন) ও গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম মণ্ডলের পালিত গুণ্ডা হিসেবে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীতে নানা বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। পতিতালয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করাসহ পতিতালয় নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নুরুল ইসলাম মণ্ডল এসব খুনি ও সন্ত্রাসীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করে বলে তদন্তে প্রকাশ পায়।’

পুলিশের তালিকাভুক্ত খুনি ও সন্ত্রাসী তমসেরকে নুরুল ইসলাম মণ্ডলের দেহরক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয় রিপন হত্যা মামলার চার্জশিটে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নুরু মণ্ডলের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্যে জামাল পত্তনদার ওরফে কিলার জামাল, হারুন, ফরিদ দেওয়ান, সোহেলের বিরুদ্ধে জোড়া খুনের মামলা রয়েছে। ২০১৪ সালের ২১ মার্চ দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর বাড়িওয়ালা সালমী বেগম ও সঙ্গে থাকা ব্যবসায়ী চান মিয়াকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গোয়ালন্দ থানায় মামলা করা হয়। ওই বছরের ২২ মার্চ দায়ের হওয়া মামলা নং-১৩। এরপর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট সিদ্দিক ডাক্তার নামে একজন গ্রাম্য চিকিৎসকের ২ ছেলে রুবেল ও সাদ্দামকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে রুবেলের লাশ পাওয়া যায় দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পেছনে পাটক্ষেতে। আর সাদ্দামের লাশ পাওয়া যায় সাভার এলাকায়। রুবেল হত্যা মামলাটি দায়ের করা হলেও ভয়ে সাদ্দাম হত্যা মামলা হয়েছে কি না, তা-ও জানেন না সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক।

তার দুই ছেলেকে হত্যার পেছনে নুরু মণ্ডল সরাসরি জড়িত আছে বলে অভিযোগ করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ওই ভয়ে আমি নিজেও মামলা করতে পারিনি। অন্য আত্মীয় রুবেল হত্যা মামলা দায়ের করেছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন আমাকেও হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল নুরু মণ্ডল। যে কারণে আমিও কয়েকদিন নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলাম।’

রুবেল হত্যা মামলায়ও নুরু মণ্ডলের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্যে ৯ জনের নাম পাওয়া যায়। তারা হলেন- কিলার জামাল, হারুন, আশরাফ, নুরু মণ্ডলের খালাতো ভাই আমজাদ, ইউসুফ, ইয়াহিয়া, সোহেল, জীবন ও মিলন মোল্লা।

২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি এ মামলায় উল্লিখিত খুনিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। সশস্ত্র এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, ঘুম, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদকসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রত্যেকটি হত্যা মামলা থেকে আসামিরা জামিনে বের হয়ে বীর দর্পে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে হত্যা মামলার সাক্ষীরা কেউ আদালতেও যেতে পারছেন না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগে যেসব হত্যাকাণ্ড

তথ্যানুসন্ধানে রাজবাড়ী জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকায় এসবিতে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের যে তালিকা পাঠানো হয় তাতে নুরু মণ্ডলের নাম পাওয়া গেছে। ২০০৬ ও ২০০৭ সালের দুটি তালিকায় তাকে খুনি ও সর্বহারা সদস্য হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এদিকে নুরু মণ্ডলের বিচার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া আবেদনপত্রে বেশ কয়েকটি খুনের বর্ণনা দিয়ে তদন্তের দাবি জানানো হয়। ৫ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগের এক স্থানে নুরু মণ্ডলের খুনের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, সর্বহারার কোন্দলে হত্যা করা হয় দেবুগ্রাম ইউনিয়নের চরবেথুরি গ্রামের ইয়াকুবকে। একই এলাকার কদম ও নুর ইসলামকে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নেয়। ওই তিন সর্বহারা ছিল নুরু মণ্ডলের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী।

এছাড়া ফেরিতে জুয়া খেলার টাকার ভাগ না দেয়ার অপরাধে সাইফুদ্দিন নামে একজনকে হত্যা করে। জুয়াড়ি মিন্টুকে ফেরির মধ্যে মেরে নদীতে ফেলে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জুয়ার টাকা আত্মসাৎ করায় ওয়ানটেনখ্যাত জুয়ার বোর্ডের নুরু নামের একজন পাহারাদারকে নুরু মণ্ডল নিজেই মেরে ফেলে। নদীতে ডাকাতি করতে গিয়ে নুরাইয়ের ছেলে হারুন ও নৌকার মাল্লাকে মেরে নদীতে ফেলে দেয়।

ছিনতাই ও ইয়াবা ব্যবসার কোন্দলে আজিজুল প্রামাণিকের ভাতিজাকে বালুর চরে নিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। নদীতে জেলেদের কাছ থেকে আদায়কৃত টাকার সঠিক হিসাব না দিতে পারায় খোকন নামে একজনকে মেরে ফেলা হয়। পতিতাপল্লীর পতিতা লাভলীকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান পলাশকে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল দিনদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নুরু মণ্ডলের সশস্ত্র ক্যাডার জিন্দার আলী, আবদুল জব্বার, আতিয়ার শেখ, নান্নু শেখ, মারফত আলী, জহুরুল ইসলাম দুদুখানপাড়া এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে পলাশ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নুরু মণ্ডলের আমলনামায় তুলে দেয়া হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে দৌলতদিয়ায় নুরুল ইসলাম মণ্ডলের বাড়িতে কয়েকদফা যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে টেলিফোনে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার জানামতে আমি এমন কোনো অন্যায় করিনি। বিএনপি ক্ষমতায় এসে আমাকে জেলে দেয়। সাড়ে চার বছর জেল খাটতে হয়। ওই সময় আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সবই মিথ্যা।’ সূত্র- যুগান্তর