বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন ও স্বামী বিবেকানন্দ

আশুতোষ সাহা

বাঙালি জাতি বড় সৌভাগ্যবান। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আজ থেকে দু’শত বছরের মধ্যে যে সকল বাঙালি-বীর যথেষ্ট অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ একজন। যিনি আজ থেকে একশত পঁচিশ বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত, আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের ছিলেন একজন অনাহুত প্রতিনিধি। সম্মেলনের সনটি ছিল আঠারোশ তিরানব্বই। মোট সতের দিনের ছিল মহা সম্মেলনটি। সতের দিনের এ সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা এতো সর্বজনীন, এতো উদারতাপূর্ণ ছিল; যে কারণে তিনি সভার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধির মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। এবং সে দেশের প্রচার মাধ্যমগুলো সমস্বরে তা ফলাও করে প্রচারও করেছিল। ত্রিশ বছর বয়সের এ বাঙালির মেধা, মনন ও তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয়ে বিমুগ্ধ হয়েছিল সেদিন সকলে। তাঁর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদানের একশত পঁচিশ বছর পুর্তি হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড় মঠ ও অন্যান্য মিশনে বিভিন্ন প্রকাশনায় বিশেষ সংখ্যা বের করছে।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার সিমলা পল্লীতে স্বনামধন্য পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু পারিবারিক গন্ডি তাঁকে সংকোচিত করতে পারেনি। একটি অসীম ভাব আশ্রয় পূর্বক তিনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। আর সে ভাবের কান্ডারি ছিল তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব। পরম হংসদেবের ঐশী নির্দেশেই তিনি বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং বিশ্ব জয় করে বিজয়ীর বেশে বঙ্গে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তাতে বিশ্বের সমস্ত ধর্মগুলোর যাঁরা নেতৃত্বদানকারী তাদের সুপ্ত সংকীর্ণ ভাব অনেক ক্ষেত্রেই বিদূরিত হয়েছিল, বিবেকানন্দের সর্বজনীন বক্তব্য শ্রবণে। ইহাই ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। সভার বক্তব্যে সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “আমরা যে সকল ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করি, শুধু তাই নয়, তাকে গ্রহণও করি।” তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব হিন্দু, ইসলাম, খ্রিষ্টান আরো অনেক মত-পথে সাধনা করে চরম সত্যে পৌঁছেছিলেন। শেষে বলেছিলেন, “যত মত তত পথ।” প্রত্যেকটি ধর্ম পরম স্রষ্টার নিকটে পৌঁছার একেকটি পথ। সকল পথে সাধনা করে পরম হংসদেব একই বস্তু প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন, “কোন ধর্মকে অশ্রদ্ধা বা ঘৃণার চোখে দেখতে নেই।” এটি তাঁর উপলব্ধ সত্য।
আর এ ভাব এবং আদর্শগুলোর বাহক স্বামী বিবেকানন্দ। তাই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন, এ সর্বজনীন ভাব প্রচারের জন্য। শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের উপায় অন্বেষনে নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন। তিনি বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন এদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভেবে। তবে তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, “এ দেশ একদিন উঠবে। ” আমরা এখন আর অনাহারক্লিষ্ট নই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, খাদ্য, সকল দিকেই উন্নতর অবস্থায়। আসলে কোন ব্যক্তি নয় তাঁর ভাবটিই বড় জিনিস। যদিও ব্যক্তি ও ভাবটি অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত। সত্য, সুন্দর, পবিত্র ভাবই জগতকে সুখের নীড়ে পরিণত করে। যারা এগুলো মনে-প্রাণে গ্রহণ করে ও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে।


এ বিশ্বজগত বিশাল এক বৈচিত্র্যের সমাহার। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সত্য, সুন্দর, স্রষ্টার অধিষ্ঠান। পৃথিবীতে যতগুলো ধর্ম রয়েছে এগুলো তাঁরই ইঙ্গিতে সৃষ্ট। একটিকে অশ্রদ্ধা করলে, প্রকারান্তরে সবগুলোকে অবজ্ঞা করা হয়। আর যিনি ধর্মগুলোর স্রষ্টা তাঁকে করা হয় অপমানিত।
একটি বাগানে যখন বিভিন্ন জাতের ফুল থাকে, তখন বাগানটি হয় পরিপূর্ণ। মানুষকে করে আকৃষ্ট। তেমনি পৃথিবীর সবগুলো ধর্ম মিলে যেন একটি গোলাপের বাগান। যা অপূর্ব শোভায় শোভিত করেছে পৃথিবীকে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সংকীর্ণতার আবহে পড়ে এ সুন্দর বাগানটিকে ধ্বংস করতে চায়। আমরা একটি স্ন্দুর গান শুনতাম, তা হলো, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবাণী।


মানুষের কল্যাণে, জীবের মঙ্গলার্থে, তিনি কত কিছু সৃষ্টি করেছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। সকল সুন্দরের পূজারী স্বামী বিবেকানন্দ। তাই সকলকে গ্রহণ করতেন, পৃথিবীর সকল প্রাণীকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসাই ছিল তাঁর মূলধন। বিশেষ করে খুব বেশি ভালোবাসতেন যুবকদেরকে। তাঁদের উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দের বিখ্যাত বাণী, “ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত থামিও না।” এ আহ্বান যুবপ্রাণে স্ফুলিঙ্গ ধরিয়ে দেয়। সবচেয়ে নিু বিষয় প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রবণতা দেখা যায়, তারা জগত স্রষ্টাকে বিভিন্ন স্থানে অন্বেষণ করে। কিন্তু কোথায়ও খোঁজে পায় না। এ উপলক্ষ্যে স্বামী বিবেকানন্দের বিখ্যাত বাণী “বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।” মানুষের মধ্যে, জীবরে মধ্যে তাঁর সূক্ষ্ম অধিষ্ঠান বোধ হলেই ধর্ম নিয়ে, সম্পদ নিয়ে হানাহানি চুকে যায়। পরিশেষে তাঁর একটি বিশেষ বাণী উল্লেখ করে লিখা শেষ করছি। “বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মত বিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।” আমরা বিবেকানন্দের ভাব প্রত্যাশী। তা যেন প্রাপ্ত হই এবং পূর্ণতা আসে জীবনে।

আশুতোষ সাহা
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা।