আমিরুল ইসলাম রাঙা।
ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নবাব আলী মোল্লা। স্বাধীনতার আগে ও পরে পাবনার রাজনীতি অঙ্গনে এক আলোচিত নাম। পাবনা শহরের দক্ষিন রামচন্দ্রপুর ( বর্তমান বাংলাবাজার এলাকা) গ্রামে আনুমানিক ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নইমুদ্দিন মোল্লা এবং মাতা পতিজান নেছা। এলাকার সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবার হিসেবে পরিচিত। সেই পরিবারে জন্ম নেওয়া নবাব আলী মোল্লা ছোটবেলা থেকেই ছিল দুর্দান্ত প্রভাবশালী এক মানুষ। রাজনীতি এবং সামাজিকতা সব কিছুতেই ছিল ব্যাপক প্রভাব। আশেপাশে দশ গ্রামের মধ্য তিনি ছিলেন মাতব্বর। এলাকার ভাষায় প্রামানিক বলা হতো। যেকোন মানুষের বিপদে পাশে দাড়াতেন। কঠিন কঠিন সামাজিক বিষয়সমুহ সহজেই সমাধান করে দিতেন। পাবনা শহর সংলগ্ন পদ্মা নদীর চরাঞ্চল জুড়ে ছিল প্রভাব আর প্রতিপত্তি।
পাবনা জিসিআই স্কুলে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৮ থেকে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মিটিং মিছিলে অংশ নিয়েছেন। ৬৭ সালে পাবনার ভুট্টা আন্দোলন এবং ৬৯ সালের গনআন্দোলনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর ভুমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার কারনে স্বাধীনতার আগে ছিলেন দোগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এবং স্বাধীনতার পর হয়েছিলেন পাবনা সদর থানা আওয়ামীগের সভাপতি। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন, সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া, দেওয়ান মাহবুবুল হক ফেরু, ওয়াজি উদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরী, আহমেদ রফিক, আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
স্বাধীনতার আগে পাবনা শহরের অবস্থা ছিল অনেক শহর থেকে আলাদা এবং বৈশিষ্টপুর্ন। এখানকার হোসিয়ারী শিল্প ,তাঁত শিল্প, বিড়ি শিল্প ছিল দেশের মধ্যে প্রখ্যাত এবং বিখ্যাত। পাবনার হোসিয়ারী ব্যবসা তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান ছাড়াও পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল। পাবনার এডরুক ছিল দেশের প্রধান ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এডরুকের ঔষধের চাহিদা বেশী ছিল। উপমহাদেশের বৃহৎ মানসিক হাসপাতাল এই পাবনা শহরে অবস্থিত। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এডওয়ার্ড কলেজে আশেপাশের ৫/১০ জেলার ছেলে মেয়েরা এখানে পড়াশুনা করতো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত পাবনার গন মানুষের ভুমিকা ছিল উল্লেখ করার মত।
ষাটের দশক থেকে সত্তর দশক হলো পাবনার হোসিয়ারী শিল্পের স্বর্নকাল। এমন সময়কালে নবাব আলী মোল্লা ছিলেন, পাবনা শহরের বড় হোসিয়ারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন সফল ব্যবসায়ী। শহরের নুতন গলির মধ্যে ঠিক পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে হলো নবাব আলী মোল্লার দোকান। নুতন গলির মুখেই বাম পাশে মোসলেম মালিথার বড় দোকান আর ডান পাশের প্রথম দোকান হলো আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দেওয়ান মাহবুবুল হক ফেরু মিয়ার । গলির মধ্যে প্রেসক্লাব সহ শ্রমিক সংগঠন সমুহের অফিস অবস্থিত। তৎকালীন সময়ে নুতল গলি হলো প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র আর রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রস্থল। তৎকালীন সময়ে রাজনীতিতে সংগ্রাম আর আন্দোলনের কর্মী বাহিনী হলো ছাত্র এবং শ্রমিক। পাবনায় স্বাধীনতার আগে সকল আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে হোসিয়ারী এবং বিড়ি শ্রমিকরা ছিল বেশী সক্রিয়। আর এই সব আন্দোলন সংগ্রামে নবাব আলী মোল্লার ভুমিকা ছিল অনেক বেশী। তাঁর নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক আর নিজের অর্থ অকাতরে প্রদান করে এক বিরাট ভুমিকা পালন করতেন।
১৯৭০ আর ৭১ সাল হলো বাঙালী জাতির এক স্মরণীয় সময়কাল। ৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিরাংঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। পাকিস্তানের সামরিক সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ সারাদেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করলো। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিন, ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, সাঈদ উদ্দিন তালুকদার সহ বহু মানুষকে আটক করে হত্যা করে। পাক সৈন্যরা শহরের বিভিন্ন স্থানে নীরিহ জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে হত্যাকান্ড চালায়। ২৬ মার্চ পাকসৈন্যরা পাবনা পুলিশ লাইনের পুলিশদের অস্ত্র সমর্পন করার আহবান জানায়। ইতিমধ্যে পাবনা পুলিশ লাইনে অবস্থিত সবাই জেনে গেছে আগের রাতে ঢাকা রাজারবাগে পুলিশ সদর দপ্তরে আক্রমন করে হাজার হাজার বাঙালী পুলিশদের হত্যা করা হয়েছে। এমন অবস্থার উল্লেখযোগ্য দিক হলো পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান এবং পুলিশ সুপার আব্দুল গাফফার পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে যোগ দেন।
২৭ মার্চ সকাল থেকে চর রামচন্দ্রপুর গ্রামে নবাব আলী মোল্লার বাড়িতে স্বাধীনতার পক্ষের নেতাকর্মীরা এবং সংগঠকরা জমায়েত হতে লাগলো। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন, সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া, ওয়াজি উদ্দিন খান, রফিকুল ইসলাম বকুল,ফজলুল হক মন্টু সহ প্রচুর নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছেন। ঐদিনই পাবনা জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান এবং পুলিশ সুপার আবদুল গাফফার সেখানে উপস্থিত হন। এরপর উপস্থিত নেতৃবৃন্দ পরবর্তী করনীয় নির্ধারন করেন। পাবনায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই মোতাবেক একদল সেচ্ছাসেবক শহরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যাদের বাড়ীতে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাদের অস্ত্রসহ নিয়ে আসতে হবে। দেশীয় অস্ত্র, বোমা, ইটপাটকেল সংগ্রহ করতে হবে। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় ২৭ মার্চ রাতের মধ্যে প্রায় ৩০ টি বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল। এরপর রাতেই পুরাতন ডিসি অফিসের ছাদ, পুরাতন এসডিও ভবন, পুলিশ লাইনের দক্ষিণ অংশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান গ্রহন করেন। ২৭ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা পুলিশ লাইনের পুর্ব পাশে এসে হ্যান্ডমাইকে পুলিশকে আত্মসমর্পণ করার কথা বলে। পুলিশও হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণে অস্বীকার করে । দুই পক্ষের এমন বাকবিতণ্ডার পর গুলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পুলিশ লাইন থেকে পুলিশের গুলিবর্ষণ আর ডিসি অফিসের উপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে পাকসৈন্যরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । শহরের চুতর্দিক থেকে গুলির শব্দ আর মুহুমুহু জয় বাংলা ধ্বনিতে সারা শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। পাকসৈন্যরা এমন অবস্থায় পিছু হটে পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ঢুকে পড়ে। আর কিছু সৈন্য পালিয়ে বিসিক শিল্পনগরীতে আশ্রয় নেয়। এরপর পুলিশ বাহিনী এবং মুক্তিকামী জনতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের চারপাশ ঘিরে ফেলে। ভোর হওয়ার আগেই ডিসি এবং এসপির উপস্থিতিতে পুলিশের অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হয়। জেলখানার ফটক খুলে বন্দীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। সকাল থেকে তুমুল আক্রমনে দুপুরের আগেই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত সমস্ত পাকসৈন্যকে হত্যা করা হয়। ২৯ মার্চ দুপুরের আগেই বিসিক নগরী থেকে পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন স্থানে খন্ত খন্ড যুদ্ধে সমস্ত সৈন্য নিহত হয়। ২৫ মার্চের পর পাবনায় প্রথম বেসামরিক প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা জেলা হানাদার মুক্ত হয়।
উপরে উল্লেখিত কথাগুলি উল্লেখ করার কারন হলো এই প্রজন্মের অনেক মানুষকে জানানো। মহান মুক্তিযুদ্ধে এমন বীরত্বপুর্ন ঘটনার কথা অনেক মানুষই জানেনা। পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরুতে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এসবই হয়েছিল নবাব আলী মোল্লার বাড়ীতে বসে। মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সহ কয়েকদিনে শত শত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া এবং খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা উনাকেই করতে হয়েছিল। এছাড়া তিনি সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা বিপুল শক্তি নিয়ে ঢাকা – আরিচা হয়ে পাবনা প্রবেশের চেষ্টা চালায়। মুক্তিকামী জনতা নগরবাড়ী ঘাটে কয়েকদিন প্রতিরোধ করে রাখলেও ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নগরবাড়ী ঘাট দখল করে পাবনা প্রবেশ করে। ইতিমধ্যে পাবনার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, নেতাকর্মী এবং যোদ্ধারা পিছু হটে পাবনা – কুষ্টিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নবাব আলী মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচ প্রশিক্ষন সমাপ্ত করে পাবনা প্রবেশ করলে নবাব আলী মোল্লা পদ্মানদীর তীরবর্তী চর অঞ্চলে তাঁদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া এলাকার তরুন যুবকদের সংগঠিত করে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। পাবনার শীর্ষ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা নবাব আলী মোল্লার কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কয়েক মাসের মধ্যে সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো । বদলে গেলো পাবনার রাজনীতি। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। এই একবছরে পাবনায় শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে মৃত্যু হলো বেশ কয়েকজন নেতার। ১৯৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর নক্সালদের হাতে খুন হলো , পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নব নির্বাচিত এমপিএ আহমেদ রফিক। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটক এবং তাদের হাতে নিহত হলো , জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও নব নির্বাচিত এমপিএ এডভোকেট আমিন উদ্দিন। ৬ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নব নির্বাচিত এমএনএ মোঃ আমজাদ হোসেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠন হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন আব্দুর রব বগা মিয়া এবং সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন, ওয়াজি উদ্দিন খান। সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন নবাব আলী মোল্লা।
স্বাধীনতার পর পাবনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে আভ্যন্তরিন দ্বন্দ্ব প্রকোট আকার ধারন করে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং তাঁর পুত্র মোঃ নাসিম পাবনায় একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব স্থাপন করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরুপ প্রভাব পড়ে। স্থানীয় নেতাকর্মী কেউ কেউ মেনে নিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং তাঁর পুত্র মোঃ নাসিমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে জনপ্রিয় সংগঠক রফিকুল ইসলাম বকুল এবং তাঁর অনুসারীরা প্রকাশ্যে মোঃ নাসিমের বিরোধী ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত পাবনায় আভ্যন্তরিন দ্বন্ধে বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭২ সালে ১২ জুলাই প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় আব্দুস সাত্তার লালুকে। লালু ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, পাবনায় গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে প্রকোট সঙ্কট সৃষ্টি হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন আব্দুর রব বগা মিয়া, ওয়াজি উদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরী ও মোঃ নাসিম। আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড আব্দুর রব বগা মিয়াকে নমিনেশন দিলে আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থী হন, অধ্যক্ষ আবদুল গনী। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোমবাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাড়িয়ে ছিলেন। উনার পক্ষে ছিলেন, ওয়াজ উদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরী, নবাব আলী মোল্লা সহ উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ। নির্বাচনে অন্য প্রার্থীরা ছিলেন, জাসদ মনোনীত মশাল মার্কায় মোঃ ইকবাল এবং ন্যাপ মনোনীত কুঁড়েঘর মার্কায় আমিনুল ইসলাম বাদশা। উক্ত নির্বাচনের আগে ২৫ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আব্দুর রব বগা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেন। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু পাবনায় আসেন। পাবনা আসনের নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু পাবনা থেকে ঢাকা ফিরে গিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওয়াজি উদ্দিন খান, সদর থানার সভাপতি নবাব আলী মোল্লা, গোলাম আলী কাদেরী, অধ্যক্ষ আবদুল গনী সহ ১১ জনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে সদর আসনের উপ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এডভোকেট আমজাদ হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং তিনি বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। আর অল্প সময়ের মধ্যে পাল্টে যায় পাবনার রাজনীতি।
নবাব আলী মোল্লাকে নিয়ে লেখতে গিয়ে অনেক বিষয় উল্লেখ করতে হলো। কারন উনি শুধু ব্যক্তি নয় উনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে পাবনার রাজনীতিতে একটি অংশ। ১৯৭৪ সালে মিথ্যা মামলায় রফিকুল ইসলাম বকুল, হাবিবুর রহমান হাবিব, রেজা, মোহন, মাহতাব উদ্দিন নিশু, আজিজুল হক, তোফাজ্জল হোসেন তোক্কেল সহ বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হয়েছিল । আর আব্দুস সাত্তার লালু’র মত বহুজনকে জীবন দিতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে নবাব আলী মোল্লার মত মানুষকে।
১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারী সন্ধ্যায় পাবনার নুতন গলিতে নবাব আলী মোল্লার দোকান ঘরে ঢুকে আততায়ীরা অসংখ্য গুলি ছুঁড়ে তাঁকে হত্যা করে। হত্যাকারীরা এত শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান ছিল যে প্রকাশ্যে হত্যা করে বীরদর্পে শত শত মানুষের সামনে দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। সেদিন হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা দুরের কথা টু শব্দ করার উপায় ছিলোনা। নিভে গেল নবাব আলী মোল্লার ৪৫ বছরের জীবন। আজ ঘটনার ৪৫ বছর পর উনাকে নিয়ে লেখতে গিয়ে বারবার উনার কৃতিময় জীবনের কথা মনে পড়ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নবাব আলী মোল্লাকে শুধু হত্যা করা হয়নি তাঁর কৃতিত্বকেও হত্যা করা হয়েছে। প্রয়াত নবাব আলী মোল্লাকে আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ রাজনীতিতে যে অবদান রেখেছেন সেটাও মুল্যায়ন করা হয়নি। প্রয়াত নবাব আলী মোল্লার দুই ছেলে আর দুই মেয়ে বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন তাঁর স্বজনেরা।
পরিশেষে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি , অনতিবিলম্বে ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নবাব আলী মোল্লাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হোক । পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য পাবনার কোন সড়ক বা কোন প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নবাব আলী মোল্লা অমর হোক। বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী হোক। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। ( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া