এবাদত আলী
অতীতে পাবনা জেলায় দানশীল, জনহিতৈষী শিক্ষানুরাগী যে সকল ব্যক্তি ছিলেন, খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
দানবীর হিসাবে খ্যাত কর্মোদ্দীপক,জনদরদী এই ব্যক্তিটি ১৮৭৩ সালে বৃহত্তÍর পাবনা জেলার বেলকুচি থানার ধুলগাগরাখালীচর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ পাতু সরকার। যিনি ছিলেন উক্ত এলাকার একজন বড় জোতদার।
বাল্যকালে গ্রাম্য মৌলভীর নিকট ওয়াছিমুদ্দিনের হাতেখড়ি হয়। সেখানে তিনি আরবী শিক্ষা লাভ করেন। তারপর তাঁকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে ঢাকা পাঠানো হয় এবং তথায় এন্ট্রান্স, আইএ এবং বিএ পাশ করেন। পরবর্তীতে বিএল পড়ার জন্য তিনি কলকাতা গমণ করেন। বিএল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
কলকাতা থেকে ফিরে তিনি পাবনা জেলাস্কুলে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। কিছু দিনের মধ্যে তিনি স্কুল সাব-ইনেসপেক্টর পদে যোগদান করেন। সে সময় ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপিত হয়নি এবং পাবনা হতে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত কোন পাকা রাস্তা ছিলনা। তাই তিনি বাইসাইকেল যোগে পাবনা শহর হতে সিরাজগঞ্জ এলাকায় স্কুল পরিদর্শনে যেতেন। সঙ্গে চিড়া-মুড়ি বেঁধে নিতেন আর তাই খেয়ে একাধিক দিন কাটিয়েছেন। স্কুল পরিদর্শনে গেলে তিনি টিএ বিল গ্রহণ করতেননা বলে জানা যায়।
খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন সরকারি চাকুরির বাঁধা ধরা নিয়মের মাঝে বেশি দিন থাকতে পারেননি। তাই সরকারি চাকুরি ইস্তফা দিয়ে তিনি ওকালতি পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। পাশাপাশি জন সেবায় ব্রতি হন। তিনি পাবনার পুরাতন টেকনিক্যাল স্কুলের নিকটে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে যা তিনি টেকনিক্যাল স্কুলকে দান করে দিয়েছিলেন ( যা বোডিং হাউস নামে পরিচিত )। তিনি এমন শিক্ষানুরাগী ছিলেন যে, সারা বছর নিজ বাড়িতে ৩০/৪০ জন ছাত্র জায়গীর রাখতেন এবং তাদের মধ্যে যারা বই-পুস্তক খরিদ করতে অপারগ ছিল তাদেরকে তিনি বই-পুস্তক কিনে দিতেন। স্কুল কলেজের বেতন নিজ তহবিল থেকে প্রদান করতেন। এমনকি তাদের জামা-কাপড়সহ অসুখ-বিসুখে ওষুধ পথ্য কিনে দিতেন। শুধু তাই নয় তিনি নিজ হাতে ও তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ ঐ সকল জায়গীর ছাত্রদের সেবা করতেন। তিনি বিভিন্ন স্কুল কলেজে ঘুরে গরিব ছাত্রদের ফ্রি- হাফ ফ্রির ব্যবস্থা করে দিতেন বলেও শোনা যায়।
খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত পাবনা পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময় তিনি পৌর এলাকায় অনেক রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ নির্মানসহ পানীয় জলের জন্য বহু সংখ্যক নলকুপ স্থাপন করেন। তিনি ’পাবনা জেলা মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করেছিলেন। তিনি ছিলেন তার সাধারণ সম্পাদক। তদ্বীয় পুত্র আবু তায়েব শামসুল হুদা কর্তৃক সংরক্ষিত একটি দলিল (অভিভাষণ) হতে জানা যায় তিনি এই বলে আহ্বান করেছিলেন যে,“হে ভাতৃগণ আপনারা এখনো পশ্চাতে আছেন। জগতে প্রত্যেক জাতি উন্নতির পথে প্রবল বেগে অগ্রসর হইতেছে। আপনারা এখনো সাবধান না হইলে আপনারা এই রূপ দশায় পতিত হইবেন যে, এই সমাজের লোক কাষ্ঠচ্ছেদন ও জল বহন ব্যতীত অন্য কোন কাজের উপযোগী থাকিবেনা। তাই বলি সময় থাকিতে সতর্ক হউন……..।”
‘‘ হে হিন্দু ভাতৃগণ। মুসলমান শিক্ষিত না হইলে দেশের প্রকৃত মঙ্গল আকাশ কুসুম বৎ থাকিবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিবার জন্য আপনাদের চেষ্টা করা উচিত। মুসলমান আপনাদের প্রজা। তাহারা আপনাদের প্রতিবেশী, সুতরাং সহানুভূতির যোগ্য। আপনাদের প্রতিবেশী দিগকে শিক্ষিত করার জন্য আপনাদের চেষ্টা করা কর্তব্য। নিজে যথাসাধ্য সাহায্য করুন ও অন্য হিন্দু মুসলমান প্রতিবেশীর দ্বারা ইহার জন্য যথোচিত সাহায্য করুন। আপনাদের বিদ্যা বুদ্ধি ও প্রতিপত্তির প্রতি এই গরিব সমাজের দাবি আছে ….। টাকা পাঠাইবার ঠিকানা- মৌলভী ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ, বি,এল উকিল, সেক্রেটারী। মৌলভী মজিদ উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী, জমিদার, প্রেসিডেন্ট,পাবনা। তারিখ ২৭ ভাদ্র ১৩১৫বাং, ১৩/০৮/১৯০৮ইং।’’
খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাবনা আঞ্জুমান-ই-ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৫ সালে তিনি ইংরেজ সরকার থেকে সমাজ সেবার জন্য খান বাহাদুর খেতাবে ভুষিত হন। দানবীর খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন তাঁর নিজ বাসভবন ছাত্রদের বোডিং হাউসের জন্য দান করে পরবর্তীকালে শহরের (নিউ মার্কেটের পাশে বর্তমানে খান বাহাদুর শপিং মল) বসত বাড়ীতে (টিনের চালা,বাঁশের বেড়া ও কাঁচা মেঝে) বসবাস করতে থাকেন।
তিনি ছিলেন মিতাহারী, মিষ্টভাষী,অতিথি পরায়ণ, বিনয় ও শরাফতির প্রতীক এবং অত্যন্ত সাদাসিদে সরল-সহজ জীবন যাত্রার অধিকারি। এক মাত্র আদালতে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজনে আইনজীবীর পোষাক পরিধান ছাড়া অন্য সময় তাঁকে ভালো কাপড় পরতে দেখা যেতনা বলে শোনা যায়। অন্যের ছেঁড়া বস্ত্র দেখলে তিনি তৎক্ষনাত তাকে বস্ত্র কিনে দিতেন।
পৌরসভার চেয়ারম্যানের পর তিনি ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যন নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯২২ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও নানাবিধ পীড়াক্লিষ্ট মানুষের বন্ধু, দানবীর খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ ১৯২৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য তাঁর মধ্যম পুত্র আবু তায়েব শামসুল হুদার(এটি শামসুল হুদা) দানে ১৯৬৪ সালে পাবনা সদরের ‘টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালা ’নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯৮৮ সালে মরহুমের স্ত্রীর নামে টেবুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ’হাজেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।’ (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।